সুচরিতা সেন চৌধুরী: অনূর্ধ্ব-১২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তার পর গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। বাংলা থেকে এখনও পর্যন্ত সায়ন্তন দাস-ই শেষ গ্র্যান্ডমাস্টার। তবে আফসোস, তাঁর এই সাফল্যের কথা কত জনই বা জানেন! বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে কী-ই বা পেলেন তিনি। তাই নিজের মতোই এগিয়ে যাওয়া। মেট্রো রেলের চাকরিটাই যা সম্বল! তাই দিয়েই দেশ-বিদেশে খেলতে যাওয়া। লক্ষ্য রেটিং বাড়ানো। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় উঠে এল এমনই অনেক কথা।
প্র: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের একটা বড় মঞ্চে সাফল্য, তার পর কি জার্নিটা সহজ হল?
সায়ন্তন: এটা ঠিক যে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আমাকে অনেকটা পরিচিতি দিয়েছিল। তার আগে আমাকে কেউ চিনতই না। খেলোয়াড়দের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্পনসর। আর তার জন্য দরকার পরিচিতি। যেটা আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই পেয়েছিলাম। আমাকে অনেকটা সাহায্য করেছিল। আমাকে দিশা দিয়েছিল। এটার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি দাবা নিয়েই থাকব। দাবা নিয়ে কেরিয়ার করা সম্ভব কি না সেটা নিয়ে তার আগে পর্যন্ত সংশয় ছিল।
প্র: তার মানে, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন দাবাটাই থাকবে?
সায়ন্তন: আসলে ছোটবেলায় তো নিজেরা খুব একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না আমরা, সেই সময় বাবা-মায়েরাই ঠিক করে দেয়— কী করব, কী করব না। তখন আমি জানতাম না কিছুই। মনে হয়, আমার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অভিভাবকদের সাহায্য করেছিল আমাকে দাবা খেলানো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। আর আমি ছোটবেলা থেকেই দাবা পছন্দ করতাম। সেটাও একটা বড় বিষয় ছিল। এখনও আমি অনেক দিন দাবা না খেললে অস্বস্তি হয়। বোর হয়ে যাই। অনেক দিন দাবা না খেললে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। যেমন, গত ফেব্রুয়ারিতে আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হই। তার পর মার্চে জার্মানি গিয়েছিলাম খেলতে। তার পর প্রায় তিন মাসের একটা ব্রেক ছিল। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আবার খেলা শুরু করেছি।
প্র: সেই সময় আপনাকে ঘিরে যে উন্মাদনা, সেটা এখন ভাবলে কেমন লাগে?
সায়ন্তন: খারাপ লাগে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যাকে আমি শেষ রাউন্ডে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম সে এখন ২৬০০ এলো রেটিংয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে দাবাটা এখনও পিছিয়ে। সে হয়ে গিয়েছে, আমি হতে পারিনি। আমি অনেক পরে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছি। ওরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ২০১৭-তে আমার সব গ্র্যান্ডমাস্টার নর্ম হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পেয়েছি অনেক পরে।
প্র: এটাই তো প্রশ্ন, সব পেয়ে গিয়েও কোথায় এত দিন আটকে থাকতে হল?
সায়ন্তন: হ্যাঁ, সেটাই। কোথাও একটা আটকে গিয়েছিলাম। ২৫০০ করাটা দরকার ছিল। মাঝখানে আমিও একটু পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তার পর চাকরিতে যোগ দিই। নতুন জায়গা হওয়ায় মানিয়ে নিতে সময় লাগে। সে কারণে টুর্নামেন্টে খেলাটা কমে গিয়েছিল। সব মিলে অনেকটা দেরি হয়ে গেল।
প্র: মনে হয়, দাবা নিয়ে অনেক বড় আকারে কেরিয়ার ভাবাটা বাংলায় এখনও বিলাসিতা। তা-ও আপনি ছোটবেলা থেকেই দাবা খেলেছেন। কী ভাবে দাবায় এলেন?
সায়ন্তন: সাত বছর বয়সে প্রথম দাবা খেলা শুরু। মনে আছে, আমাদের বাড়িতে বোর্ড ছিল না। কিন্তু কোথা থেকে ঘুঁটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। পুরনো কারও ছিল। সেই সময় বাবা মেঝেতে দাবার বোর্ড এঁকে আমাকে খেলা শিখিয়েছিল। দাদুও দাবা খেলত এখানে যখন আসত। সেই সময়েও হারলে মানতে পারতাম না। যত ক্ষণ না জিততাম, সবাইকে আমার সঙ্গে খেলে যেতে হত। এমনও হয়েছে, সারা দিন ধরে খেলা হয়েছে ওই ছোটবেলায়।
প্র: তার পর প্রথাগত শিক্ষা কোথায়?
সায়ন্তন: বাড়ির পাশে ক্যালকাটা চেস অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হই। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে চলে যাই অ্যালেখাইন চেস ক্লাবে। সেখানে অনেক বছর ছিলাম। এই দুটো জায়গা থেকেই শেখা।
প্র: একটা সময় আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল। কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয়েছে। সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানো কতটা কঠিন?
সায়ন্তন: ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য ছিল গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। একটা সময় যখন এই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়াটা আটকে গিয়েছিল তখন খুব ভাবতাম, কেন হচ্ছে না। গত বছর এক বার ফ্রান্সে যখন খেলতে গেলাম, সেখানে গিয়ে আমাদের ভারতের শশী কিরণের সঙ্গে দেখা হল। উনি সেখানে শীর্ষ বাছাই ছিলেন। সেই সময় যখন ওঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি বলেছিলাম, আমার গ্র্যান্ডমাস্টারটা হচ্ছে না। সেই সময় উনি বলেছিলেন, গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়ে না ভাবলেই হয়ে যাবে। এবং সেটায় কাজ হল। ফেব্রুয়ারিতে যখন ফ্রান্সে যাই, তখন আমি টাইটেল নিয়ে ভাবিনি। শুধু নিজের খেলাটা নিয়ে ভেবেছিলাম। আর তাতেই আমি টুর্নামেন্টও জিতি এবং গ্র্যান্ডমাস্টারও হই। এটাই প্রমাণ করে আসল হচ্ছে মাইন্ডসেট।
প্র: এর পর লক্ষ্য কী? না কি লক্ষ্য না রেখেই এগিয়ে যাওয়া!
সায়ন্তন: লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে লক্ষ্য নিয়ে চাপ না নিলে সেটাই ভাল। যদিও গ্র্যান্ডমাস্টারই শেষ নয়। এখানেই থেমে গেলে হবে না। এর পর ২৬০০, ২৭০০-তে পৌঁছতে হবে।
প্র: কোচিং সমস্যার কথা সবার কাছে শুনছি। আপনিও কি একই সমস্যার মুখে পড়েছেন?
সায়ন্তন: ভারতে এখন অনেক প্লেয়ার রয়েছে। বাংলাতেও উঠেছে। সব খুব দ্রুত এগোচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে তথ্য সারা ক্ষণ আপডেট হচ্ছে। তাই সারা ক্ষণ নিজেকে আপডেট রাখতে হচ্ছে। কোচিংটা গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে বাইরের দাবাড়ুরা সাফল্য পায় দ্রুত। যাঁদের কাছে স্পনসর রয়েছে। কোচিং খুব ব্যয়সাপেক্ষ। বাংলায় স্পনসর না থাকায় সেটা কঠিন হয়ে যায়। আমি কোচিং নিই না এখন আর। তবে নিজেকে আপডেট রাখার জন্য এক জনের সঙ্গে কাজ করছি। যাতে দু’জনেরই কাজে লাগে। কোচিং নিতে পারলে ভাল হত। এক বার আমি আর দীপ্তায়ন এক জনের কাছে গিয়েছিলাম। প্রচুর টাকার ব্যাপার। যা রোজ সম্ভব নয়।
প্র: সামনে এখন কী কী রয়েছে?
সায়ন্তন: আমি ইউরোপ যাচ্ছি খেলতে। প্রথমে চেকে, সেখান থেকে ফ্রান্সে যাব। এখন লক্ষ্য, যত খেলা যায় আর এলো রেটিং বাড়ানো যায়। সঙ্গে আমি নিজের খেলার স্টাইল বদলানোর চেষ্টা করছি। সে ক্ষেত্রে এক জন গাইড থাকাটা দরকার। সেটা খুঁজতে হবে। আপাতত আমি কয়েক জনের সঙ্গে কাজ করি। এক জনকে সাহায্যও করেছি কিছুটা সেকেন্ডের মতো।
প্র: নানা সমস্যার মধ্যেও ভারত দাবা বিশ্বে দ্বিতীয়, সেটা কী করে?
সায়ন্তন: এটা ঠিক। আশা করছি, দ্রুত দাবা ভারতে বিখ্যাত হয়ে যাবে। গোটা বিশ্বে সব টুর্নামেন্টে ভারতীয়েরা খেলবেই। একটা সময় ভারতে ক্রিকেট ছাড়া অন্য কিছু ভাবা হত না। তার থেকে অল্প কিছুটা হলেও অভিভাবকেরা বেরিয়েছে। ছেলেমেয়েরা দাবাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে। আমাদের দেশে এখনই ৮২ জন গ্র্যান্ডমাস্টার রয়েছেন। আমার বিশ্বাস এই বছরেই সেটা ৯০-এ পৌঁছে যাবে। ভারতীয় দাবা উন্নতি করছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
প্র: বয়সভিত্তিক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আমাদের দেশে অনেক। কিন্তু সিনিয়র পর্যায়ে সেই একা বিশ্বনাথন আনন্দ, এটা কেন?
সায়ন্তন: এখন আনন্দের কাছাকাছি অনেকে পৌঁছে গিয়েছেন। ২৭০০ রেটিংয়ে ভারতে এখন চার জন রয়েছেন— আনন্দ, হরি কৃষ্ণা, বিদিত আর গুকেশ। ভারতীয় দাবায় একটা রেভোলিউশন হয়েছে। তবে জার্নিটা কঠিন। গুকেশের ক্ষেত্রে শুনেছিলাম, ও কখনও ইঞ্জিন ব্যবহার করেনি। এই পর্যায়ে পৌঁছতে অনেক বলিদানের প্রয়োজন। আমাদের দেশে ২৭০০ মানে সব জানে। এই জায়গায় পৌঁছনো কঠিন।
প্র: সব সময় আমরা গুকেশ, বিদিত, প্রজ্ঞানন্দদের নাম শুনছি সবার মুখে। কোনও বাঙালির নাম কেন শুনছি না?
সায়ন্তন: ওটাই তো সমস্যা। মাইন্ডসেট। এই তো আমার পরেই আর এক জন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে, সে সঙ্গে সঙ্গেই স্পনসর পেয়ে গিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে ২.৫ কোটি টাকাও পেয়েছে। আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছি হয়তো কেউ জানেই না। ওদের সরকার ওদের প্রচুর সাহায্য করে। আমাদের এখানে কোনও সাহায্য নেই। সেটাই সব থেকে বড় সমস্যা। এটা বদলালে সবটা বদলে যাবে।
প্র: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের স্বাদ এক বার পেয়েছেন, সিনিয়র পর্যায়ে সেই স্বপ্নটা দেখেন?
সায়ন্তন: বয়সভিত্তিক তো এক রকম। কিন্তু সিনিয়র পর্যায়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা তো একটা স্বপ্ন। আমিও দেখি। তবে সেখানে পৌঁছনোর যে রাস্তা, সেই শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি নিজেকে উন্নত করার। যতটা পারি দাবায় সময় দেওয়া, অনেক বেশি টুর্নামেন্ট খেলা। বাইরে গিয়ে খেলা। নতুন চাল, আইডিয়া তৈরি করার চেষ্টা করছি।
প্র: সায়ন্তনের আইডল প্লেয়ার কে?
সায়ন্তন: এখন সবার আইডল প্লেয়ার কার্লসন। আমারও। কার্লসনের মেন্টাল স্ট্রেন্থ অসম্ভব। ও সেটা দিয়েই বাজিমাত করে। খেলার স্টাইলের থেকেও আমার সেটা বেশি পছন্দ। রেটিংয়ে-ও ও সবার থেকে অনেক এগিয়ে। মাইন্ড গেম খেলেই ও জিতে নেয়। ও প্রতিপক্ষের দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। ও জানে প্রতিপক্ষকে কোথায় গিয়ে আঘাত করলে সে হাল ছেড়ে দেবে। একটা গেম খারাপ গেলে দারুণ ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ও। এগুলো মোটিভেশনের মতো কাজ করে। আমার অসময়ে এগুলো আমাকে সাহায্য করেছে।
প্র: ক্লাসিক্যাল, ব্লিৎজ ও র্যাপিডের মধ্যে কোনটা খেলতে আপনার বেশি ভাল লাগে?
সায়ন্তন: আমার পছন্দ ক্লাসিক্যালই। এখন যদিও পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। সব কিছু ফাস্ট হয়ে গিয়েছে। অনেকেই ঝুঁকছে ব্লিৎজ এবং র্যাপিডের দিকে। আগে যেমন কোচেরা বলতেন, দ্রুত চাল না দিতে, ভেবে দিতে। এখন সেটা বদলেছে। নিহাল, প্রজ্ঞানন্দ, গুকেশরা খুব দ্রুত খেলা পছন্দ করে। এখন এটাই চলছে। আমি ক্লাসিক্যালই পছন্দ করি। তবে বাকিগুলোও ভাল।
প্র: ভারতে দাবার উন্নতিতে কী কী প্রয়োজন?
সায়ন্তন: আমার মনে হয়, আরও বেশি টুর্নামেন্ট হওয়া উচিত ভারতে। বিশেষ করে লিগ চালু হওয়া উচিত। ইউরোপে যেমন সারা বছর ধরে লিগ চলে। যে কারণে ওখানে দাবাড়ুরা অনেক সাহায্য পায়। আমাদের জন্য ওখানে গিয়ে লিগ খেলাটা খরচসাপেক্ষ। তাই ভারতে যদি লিগ শুরু হয়, তা হলে সুবিধে হবে। অনেক প্লেয়ার উঠছে এই দেশ থেকে। ভারত এখন দু’নম্বরে রয়েছে। এক নম্বরে পৌঁছনো শুধু সময়ের অপেক্ষা। লিগ পর্ব শুরু হলে আরও ভাল হবে, আরও উন্নতি হবে। আমি শুনছিলাম, ফেডারেশন চেষ্টা করছে। হয়ে যাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
যে বাবা ঘরের মেঝেতে এঁকে দাবা বোর্ড বানিয়ে ছেলেকে খেলা শিখিয়েছিলেন, তিনি আজ নেই। ছেলের গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া দেখে যেতে পারেননি তিনি। তবে বাবা-মায়ের প্রতিদানকে নিজের কাজ দিয়ে যথাযথ সম্মান দিয়ে চলেছেন সায়ন্তন। এক বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন ছোটবেলায়। এ বার তিনি সেটা পেতে চান সিনিয়র পর্যায়ে। স্বপ্নটা অনেক বড়। রাস্তাটাও কঠিন। তবে হাল ছাড়তে নারাজ তিনি।
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার