সুচরিতা সেন চৌধুরী: ক্রিকেট বিশ্বকাপ ১৯৮৩-র মঞ্চে ভারত থেকে তিনিই ছিলেন একমাত্র ফটোজার্নালিস্ট। তিনি শ্রেনিক শেঠ। তাবড় তাবড় বিদেশিদের বিশাল সব ক্যামেরার মাঝখানে একটা সময় নিজের ক্যামেরাটাকে ছোটই মনে হচ্ছিল কিন্তু সেই বৈপরিত্য তাঁকে থামিয়ে দিতে পারেনি। সমানে সমানে নিজের সেরা ফ্রেমগুলো একটার পর একটা বন্দি করে গিয়েছেন তিনি। শুধু কী তাই? ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় বিশ্বকাপ তাই ফাইনালে দল না উঠলেও ব্রিটিশদের বাড়বাড়ন্ত ছিলই। ছবি তোলার জন্য সেরা জায়গাটা দখলে ছিল তাঁদেরই। আর শ্রেনিক শেঠদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল একটা কোণায়। যেখান থেকে মনের মতো ছবি ক্যামেরায় বন্দি করা সম্ভব হচ্ছিল। এক কথায় এটা ছিল বর্ণবৈষম্যের প্রভাব। কিন্তু এই সবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন লর্ডসের গ্যালারিতে। কীভাবে সে এক বড় কাহিনী। তবে তাঁর ক্যামেরায় তোলা লর্ডসের গ্যালারির সেই সব ছবি আজও শিহরণ জাগায়। গোটা দেশের অনেক সংবাদ মাধ্যমে তাঁর ছবি জায়গা করে নিয়েছিল সেই সময়। কখনও নামে কখনও বেনামে আজও সেই সব ছবি দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায়।
দেখতে দেখতে সেই দিনের কেটে গিয়েছে ৪০ বছর। আজ আরও একটা ২৫ জুন। বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই সব মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে শ্রেনিক শেঠ ডুব দিলেন স্মৃতির গভীর সাগরে। এর আগে ভারত বিশ্বকাপ জেতেনি। জেতার তেমন কোনও ইঙ্গিতও ছিল না। তবে তাঁর মনের কোণায় একটা ক্ষিণ আশা ছিল। বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেট কিন্তু উন্নতি করছিল। ১৯৭৮ থেকে তার শুরু। সেই সময় সুনীল গাভাস্কার ভারতের অধিনায়ক। বিশ্বকাপের আগে কপিল দেবের হাতে ওঠে দায়িত্ব। কপিল আসার পর ভারতীয় দলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজটাই বদলে গিয়েছিল। মনের কোণায় একটা আশা ছিলই। এটিই ছিল অলরাউন্ডার সেরা টিম। আর ইংল্যান্ডের পরিবেশ মিডিয়াম পেসারদের সাহায্য করে। সব মিলে আমার মনে হয়েছিল ভারত কিছু একটা করবে। শেষ পর্যন্ত লড়াই দেবে। হারার আগে হারবে না।’’

সেই সময় বিদেশ যাওয়া সহজ ছিল না আজকের মতো। অনেক কষ্ট করে যেতে হয়েছিল তাঁকে। ব্যাঙ্ক থেকে পার্সোনাল লোন নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। তার পর দেশে ফিরে ছবি বিক্রি করে সেই টাকার একটা অংশ শোধ করেছিলেন। এই পর্যায়ের প্যাশন থাকলেই হয়তো এমন উচ্চমানের কাজ করা যায়, তা শ্রেনিক শেঠকে দেখলে বোঝা যায়। সে কারণে তিনিই একমাত্র ভারতীয় ফটোগ্রাফার যিনি ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের সব ম্যাচের ছবি তুলেছিলেন। যেই কৃতিত্ব আর কারও নেই। কিন্তু ওই যে বর্ণবিদ্বেষের প্রভাব তাঁকে একটা কোণায় ঠেলে দিয়েছিল যা কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বলছিলেন, ‘‘এমন একটা জায়গা থেকে ছবি তুলতে দেওয়া হচ্ছিল প্রায় দেড়তলা উপর থেকে। যেখান থেকে ফ্রেমের কোনও পরিবর্তন সম্ভব ছিল না। শুরুতে সেটাই করছিলাম। ফাইনালের দিন মনে হল ভারত ফাইনাল খেলছে আমি আমার অনেক অ্যাঙ্গেলের ছবি দরকার। আয়োজকদের সে কথা বলিও। লয়েড আউট হওয়ার পর আমি যখন বুঝলাম খেলাটা ঘুরছে তখন আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। সব বাক্স বন্দি করে সোজা লর্ডসের ব্যালকনির নিচে চলে যাই। এবং শেষ পর্যন্ত লর্ডসের ব্যালকনিতেও উঠেছিলাম কিন্তু তার জন্য প্রচুর লড়াই, ঝগড়া করতে হয়েছিল।’’

আর এই লড়াইটাই বাজিমাত করতে সাহায্য করেছিল তাঁকে। ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে। মাঠের ভিতর থেকে দৌঁড়ে আসছেন প্লেয়াররা। আর সেই মাঠ ঢেকে গিয়েছে মানুষে। থিক থিক করছে মানুষ। কেউ নাচছে, কেউ একটু ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছে প্লেয়ারদের, সে এক অভিনব দৃশ্য। লর্ডসের ব্যালকনি থেকে সেই আবেগের মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন তিনি। আরও একটা অসাধারণ মুহূর্ত তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। তিনি বলছিলেন, ‘‘সান্ধুর বলে গ্রিনিচের বেল উড়ে যাওয়ার সেই মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করার পরই মনে হল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য অত সহজ হবে না। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পিছন থেকে গ্রিনিচ আর বেল দুটো হাওয়ায়। এটাও একটা প্রাপ্তি। ভিভ রিচার্ডস আউট হওয়ার পর ধরেই নিয়েছিলাম এই ম্যাচ আমাদের।’’
সেই সময় আরও একটা ঘটনার সাক্ষী থেকেছিলেন তিনি। যা পরবর্তী সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে বিপুল পরিমাণে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেটা হল বেটিং। চোখের সামনে বেটিং চলছিল। তিনি বলছিলেন, ‘‘বেটিংটা চলছিল মাঠের কোণায় কোণায়। যেমন ১০ পাউন্ডের বিনিময়ে ১০০ পাউন্ড। যখন ভিভ আউট হল তখন সেটা ৩০-এ নেমে এল। ক্লাইভ লয়েড আউট হওয়ার পর সেটা উল্টে গিয়ে ভারতের পক্ষে হতে শুরু করল। অনেক পরিচিতই তখন আমাকে তাতে টাকা লাগাতে বলেছিল। কিন্তু আমি সেটা থেকে দূরেই ছিলাম। বলেছিলাম, ভারত জিতলে সেই টাকা দিয়ে আমি সেলিব্রেট করব।’’ এর পরটা তো ইতিহাস ভারতীয় খেলায়, ভারতীয় ক্রিকেটে।

এই জয়ের সেলিব্রেশনও চলেছে দীর্ঘদিন। ইংল্যান্ড থেকে ভারত পর্যন্ত। ইংল্যান্ডে ভারতীয় দলের সেলিব্রেশনের অংশ ছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় দল ছিল ওয়েস্ট মুডল্যান্ড হোটেলে। লর্ডসের লাগোয়া হোটেল। মাঠ থেকে হেঁটেই হোটেলে ফিরত ভারতীয় দল। তখনই আমার সঙ্গে ভিভ রিচার্ডসের আলাপ। তার পর তো প্রায় দু‘ঘণ্টা ধরে চলে সেলিব্রেশন। তার পর অনেক সেলিব্রেশন হয়েছে কিন্তু ওই মুহূর্তটা আলাদাই যা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। সেখানে প্লেয়ারদের স্ত্রীরা ছিলেন সবাই। কপিলের কিছু পঞ্জাবী বন্ধু হাজির হয়েছিলেন। ফ্যানরা ঢাকঢোল বাজিয়ে হোটেলের লবিতে উৎসব করছিল। একটা সময় এই লবিটাকেও ছোট মনে হচ্ছিল।’’
এর পর টিম দেশে ফিরে আসে। যদিও দেশে ফেরার কথা ছিল না দলের। ওখান থেকেই আমেরিকা খেলতে যাওয়ার কথা ছিল দলের। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের ফলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দলকে দেশে ফিরতে বলেন। টিকিট পাঠিয়ে দলকে দেশে ফেরায় ভারত সরকার। সেই দলের কোনও স্পনসর ছিল না। তাই বার বার যাতায়াতও সম্ভব ছিল না। শ্রেনিক শেঠ বলছিলেন, ‘‘সেই সময় ভারতকে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার জন্য টিকিটটা স্পনসর করেছিল এয়ার ইন্ডিয়া। আর টি বোর্ড দিয়েছিল একলাখ টাকা। তাদের লোগো সোয়টারে ব্যবহার করা হত। এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দেশে ফেরার টিকিট ভারত সরকার জয়ের পর পাঠায় দলকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্য। তার পর আবার আমেরিকা পৌঁছয় ভারতীয় দল। আমি সরাসরি চলে গিয়েছিলাম। কারণ দেশে ফিরে আবার যাওয়ার মতো পুঁজি আমার কাছে ছিল না। আমেরিকায় ভারতীয় দল পৌঁছনোর পর ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তরফে ওখানে ডিনার দেওয়া হয় দলকে। আমিও আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম সেখানে।’’
সেই সময় থেকে আজকের সময়—বদলে গিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারা। এখন আর ড্রেসিংরুমে ঢুকতে পারেন না সাংবাদিকরা। তবে তার জন্য যে দায়ী অনেকটাই বেটিং বা ম্যাচ ফিক্সিং সেটা মেনে নিচ্ছেন তিনি। বলছিলেন, ‘‘আমাকে ভালবেসে প্লেয়াররা ড্রেসিংরুমে ডেকে নিয়ে যেত। তখন সহজ ছিল। ১৯৯২-এর পর থেকে পরিস্থিতিটা বদলে গেল। পরবর্তী সময়ে প্রমাণ হয় বেশ কিছু সাংবাদিকও যুক্ত ছিল। আমার মনে হয় আমি খুবই ভাগ্যবাণ সঠিক সময়ে বেড়িয়ে আসতে পেরেছিলাম।’’ সেই সময় ৩৭টি সংবাদ মাধ্যমে তাঁর ছবি ছাঁপা হয়েছিল। তার পরও এই পেশাকে বিদায় জানিয়েছেন তিনি। তার জন্য কোনও আফশোস নেই। বরং মনে করেন সঠিক জীবনযাত্রার জন্য সেটাই ঠিক ছিল। তবে যেখানেই থাকুন না কেন আর যে পেশাতেই চলে যান না কেন শ্রেনিক শেঠের মনোজগতে আজও শ্রেষ্ঠ জায়গায় থেকে গিয়েছে ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ। আজও তাই অনর্গল বলে যেতে পারেন সেই অভিজ্ঞতা যা চুপ করে বসে শুনতে হয়। এই প্রজন্মের সেই মুহূর্ত নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। তাই অলস্পোর্ট পাবলিকেশনের ‘মিরাকেল অ্যাট লর্ডস’ বইয়ে তিনি ধরে রেখেছেন সেই ঐতিহাসিক সময়কে যাতে এই প্রজন্ম, এই সময়ের ক্রিকেটপ্রেমীরা সেই ইতিহাসকে উপভোগ করতে পারেন।
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার