অলস্পোর্ট ডেস্ক: ডুরান্ড কাপ জয়ের মাধ্যমে মরশুমের প্রথম লক্ষ্য পূরণ হল মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের। এ বার পরবর্তী লক্ষ্য এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বের গণ্ডী পেরনো, যা তারা গতবারেও পেরিয়েছিল। কিন্তু জোনাল সেমিফাইনালে হার তাদের ফাইনালের রাস্তা থেকে ছিটকে দেয়। এ বার তাই এএফসি কাপের ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছনোর লক্ষ্যে দুর্দান্ত দল গড়েছে তারা।
এ বারের দলে দেশের সেরা ফুটবলাররা এবং বিশ্বকাপ, ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ ও ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা বিদেশি তারকারা মজুত। কিন্তু এই দল না কি এখন অর্ধেক তৈরি এবং এই অর্ধেক তৈরি দল নিয়েই ডুরান্ড কাপের খেতাব জিতে নিল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট! তা হলে পুরোপুরি তৈরি হলে দলটা কেমন দাঁড়াবে?
ডুরান্ড ফাইনালের আগেই ফেরান্দো সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “এখনও আমরা প্রায় সেই (অর্ধেক প্রস্তুত) জায়গাতেই রয়েছি। নিজেদের যে ঠিকমতো তৈরি করব, সে জন্য আমরা তো অনুশীলনই করতে পারছি না। গত দশদিনে চারটে ম্যাচ খেলতে হয়েছে আমাদের। সে জন্য ম্যাচ, ম্যাচের পর রিকভারি, আবার পরের ম্যাচের প্রস্তুতি এই ভাবেই এগিয়ে চলছি আমরা। দলের সার্বিক প্রস্তুতির সুযোগই পাচ্ছি না। ডুরান্ড কাপ শেষ হলে ভাবছি ফের প্রাক-মরশুম প্রস্তুতি শুরু করব আমরা”।
এই কথাগুলো মোহনবাগান কোচ বলেছিলেন ফাইনালের আগে। আর ফাইনালের পরে তিনি বললেন, “ডুরান্ড কাপের আগে আমি বলেছিলাম ঠিকই যে, এটা প্রাক মরশুম প্রস্তুতির সময়, এখনও আমাদের ওঠা-নামায় ও পজিশনাল অ্যাটাকে আরও উন্নতি করতে হবে। কিন্তু দলের চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রত্যেকেই দলকে সাহায্য করতে চাইছে। তাই মরশুমের শুরু থেকেই আমরা সাফল্য পেতে শুরু করেছি। হাজার ঘণ্টার ট্যাকটিকাল অনুশীলনের চেয়ে সুখী ড্রেসিংরুম কিন্তু অনেক ভাল। এটাই (ডুরান্ড) সেরা ফাইনাল বা এটাই সেরা ডার্বি বলে মনে করি না আমি। কারণ, এখনও এ মরশুমের আইএসএলে দুটো ডার্বি খেলা বাকি আছে আমাদের”।
রবিবার কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে চিরপ্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গল এফসি-কে ১-০-য় হারিয়ে ডুরান্ড কাপের খেতাব জিতে নেয় গতবারের আইএসএলের নক আউট চ্যাম্পিয়নরা। অনিরুদ্ধ থাপা লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ায় ম্যাচের শেষ ৪০ মিনিট দশ জনে খেলেও রীতিমতো লড়াকু জয় পায় সবুজ-মেরুন বাহিনী।
সপ্তাহ তিনেক আগে মরশুমের প্রথম ডার্বিতে হারের ফলে মোহনাবাগানের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নিজেদের গোলসংখ্যা ও অন্য দলের ফলের ভিত্তিতে তারা নক আউটে পৌঁছয় এবং টানা চার ম্যাচে জিতে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে নেয় হুয়ান ফেরান্দোর দল।
তিন সপ্তাহ আগে ডার্বিতে হেরে যায় তারা। ফাইনালের ৭১ মিনিটে একক দক্ষতায় দুর্দান্ত এক গোল করে দলকে এগিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ান ফরোয়ার্ড দিমিত্রিয়স পেট্রাটস। এই গোলেই শেষ পর্যন্ত ফাইনাল ম্যাচ জিতে নেয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। এই গোলের দশ মিনিট আগেই মোহনবাগানের উইঙ্গার অনিরুদ্ধ থাপাকে ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হয়। ফলে শেষ ৪০ মিনিট (বাড়তি সময় সহ) তাদের দশজনেই খেলতে হয়। তা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয় দেখে অনেক মোহনবাগান সমর্থক বলছেন, এটাই সেরা ডার্বি জয়। কিন্তু কোচ যা বলছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভাল পারফরম্যান্স দেখিয়ে ডার্বি জেতার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবুজ-মেরুন শিবির।
প্রথমত, চল্লিশ মিনিট দশজনে খেলে জয় এবং দ্বিতীয়ত প্রথম এগারোয় জেসন কামিংসকে না রেখে শুরু করেও ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে জয়। রক্ষণে ব্রেন্ডান হ্যামিলও ছিলেন না। তাঁর জায়গায় সদ্য কলকাতায় আসা হেক্টর ইউস্তেকে প্রথম এগারোয় রাখতে বাধ্য হওয়া। এ সবের জন্যই এই জয় আরও মধুর বলে মনে করেন সমর্থকেরা। কিন্তু কোচ বলছেন, “জেসনকে শুরু থেকে না খেলানোটা একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত। দু-দিন ও আর দিমি একসঙ্গে ৮০-৯০ মিনিট মাঠে ছিল। তাই আজ একজনকে খেলাতে চাইছিলাম। তাই জেসনকে দ্বিতীয়ার্ধে নামাই। কারণ, দিমি ও মনবীরকে দ্বিতীয়ার্ধে নামানোর পরিকল্পনা ছিলই আগে থেকে। এটাই ছিল আমাদের কৌশল। কিন্তু লাল কার্ডের জন্য সেই পরিকল্পনাতেও পরিবর্তন আনতে হয়। ও যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের সেরাটা দিয়েছে, সে জন্য আমি খুশি”।
রবিবারের ফাইনাল জিতে ২৩ বছর পর ডুরান্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও একটা কালো দাগ রয়ে গেল, অনিরুদ্ধ থাপার লাল কার্ড। ম্যাচের ৬১ মিনিটে বল দখলের লড়াই করতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিওর মুখে কার্যত পা দিয়ে আঘাত করেন থাপা। যার ফলে তাঁকে ম্যাচের দ্বিতীয় হলুদ তথা লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। দশ জন হয়ে যাওয়ার পরে যেমন জয়সূচক গোল করেন দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, তেমনই ৪০ মিনিট ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তাদের রক্ষণের খেলোয়াড়রা।
এই লড়াইয়ে মুগ্ধ তাদের কোচ। বলেন, “পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠলে দলের উচিত আরও ভাল খেলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা। মাঠে এবং মাঠের বাইরের খেলোয়াড়দেরও তখন দলকে ট্রফি জেতানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কৌশলে কিছু পরিবর্তন করেছিলাম আমরা। তবে এই দলটার প্রাণশক্তি অফুরাণ। গত মরশুমেও এই দলটা চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে আইএসএল ট্রফি জিতেছিল। সেই জন্যই বলছি, এই দলের চারিত্রিক দৃঢ়তা অসাধারণ”। ফাইনালের গোলদাতা দিমি পেট্রাটসের ভূয়ষী প্রশংসা করে ফেরান্দো বলেন, “ওর দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। ও জানে কী করে চাপ সামলে ভাল খেলতে হয়, গোল করতে হয়। সে জন্যই জেসনের বদলে ওকেই শুরু থেকে খেলাই”।
জয়ের নায়ক পেট্রাটস তাঁর গোলের পরে যে দৌড়টি দেন, তা বহুদিন মনে থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের। সতীর্থদের সঙ্গে সেলিব্রেশনের পর তিনি সোজা দৌড়ে যান যুবভারতীর একাংশের গ্যালারির ফেন্সিংয়ের সামনে। সেখানে গিয়ে চরম উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে দু’হাতে ফেন্সিং আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করেন তিনি। গ্যালারির সেই অংশে ছুটে আসেন কয়েক হাজার সমর্থক। অবস্থা আয়ত্তে আনতে কর্তব্যরত পুলিশদেরও হিমিশিম খেতে হয়।
কেন এতটা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, জিজ্ঞাসা করায় অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলের এই সদস্য বলেন, “খুশি তো বটেই, খুব আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিলাম তখন। কারণ, এই গোলটা সমর্থকদের জন্য, তাদের উল্লাসের জন্য করা। আমি তো এটাই চাই। অনেকেই ফাইনাল দেখতে চেয়েও টিকিট না পেয়ে মন খারাপ করেছিল। অনেকে সারা রাত লাইন দিয়ে টিকিট কেটে আমাদের জয় দেখতে এসেছিলেন। এই জয় তাদের জন্য। আমার ওপর সমর্থকদের আস্থা আছে। ওদের ও ক্লাবের জন্য আমি আরও ট্রফি জিততে চাই”।
অন্য দিকে, হতাশ হলেও ভেঙে পড়ার পাত্র নন ইস্টবেঙ্গলের স্প্যানিশ কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। তাঁর মতে, লাল কার্ডটাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “বিপক্ষের ওই লাল কার্ড আমরা চাইনি। কারণ, ১১ জনের বিরুদ্ধে দশ জনে ডিফেন্ড করা অনেক সোজা। শুধু ডিফেন্ড করো, সবাইকে বক্সে টেনে আনো এবং কাউন্টার অ্যাটাকের জন্য অপেক্ষা করো। ওদের দলের অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় রয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের অনুপস্থিতিই আমাদের ক্ষতি করে দিল। তবে আমার দলের ছেলেদের জন্য আমি গর্বিত। যখন খেলাটা ১১ বনাম ১১ ছিল, তখন কিন্তু আমরাই বেশি বিপজ্জনক ছিলাম”।
এই ম্যাচে যেমন বল দখলের লড়াইয়ে ৫২-৪৮-এ এগিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল, তেমনই তারাই বেশি শট নেয় গোলে। মোহনবাগান যেখানে সারা ম্যাচে একটিই শট গোলে রেখে সেটি থেকেই গোল তুলে নেয়, ইস্টবেঙ্গল কিন্তু তিনটি শট গোলে রাখে। কিন্তু জালে জড়াতে পারেনি কোনওটিই।
তবে ফাইনালের লড়াই দেখে মুগ্ধ কুয়াদ্রাত, যিনি মাঠে বারবার প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং রেফারিদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিও করেন অনেকক্ষণ। একবার রেফারি রাহুল গুপ্তা তাঁকে হলুদ কার্ডও দেখান। তাঁর সহকারী দিমাস দেলগাদো আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং তাঁকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তবে খেলার পরে সাংবাদিকদের সামনে বেশ হাসিখুশি মেজাজেই ছিলেন কুয়াদ্রাত। বলেন, “এত মানুষ সমর্থক, এত ভাল পরিবেশের মধ্যে যেন একটা ফুটবল উৎসব হয়ে গেল। অসাধারণ একটা ম্যাচও হল ফাইনালে। আবেগ আর কৌশলের যুদ্ধে দুর্ভাগ্যবশত আমরাই হেরে গেলাম। তবে ভারতীয় ফুটবলের পক্ষে এটা খুবই ভাল। এত মিডিয়ার আগ্রহ, এই কলকাতায় যা সত্যিই খুব ভাল দিক”।
অনেক বছর পরে ক্লাবকে অন্তত পদক জেতাতে পেরে খুশি লাল-হলুদ কোচ বলেন, “অনেক বছর পরে ক্লাবে অন্তত পদক তো এল। শেষবার এই ক্লাবে পদক এসেছিল ২০১৮-য় আর শেষবার চ্যাম্পিয়নের ট্রফি এসেছিল ২০১২-য়। মাঝের এই সময়টা সমর্থক, কর্মকর্তা, ইনভেস্টরদের কাছে ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সময়। আমাদের এ বার ইতিবাচক হতে হবে। কারণ, যে কোনও প্রকল্পই সফল হতে সময় লাগে। আমরা যেমন তিন বছর ধরে আইএসএলে খেলছি, তেমনই মোহনবাগানও তিন বছরই খেলেছে। ওরা কিন্তু বিশাল অর্থ ব্যয় করে দল গড়ে সবে গত বছরই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার আগে দু’বার সেমিফাইনাল ও ফাইনালে পৌঁছতে পেরেছে। এ বার ডুরান্ড কাপও জিতল। আমি বলতে চাই, ২০২০ থেকে ওরা ফাইনালে উঠে যা কিছু শিখেছে, তা কাজে লাগিয়ে এ বার চ্যাম্পিয়ন হতে শুরু করেছে। আমাদেরও সে ভাবেই এগোতে হবে। ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের কাছে এটাই আমার বার্তা”।
(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার