অলস্পোর্ট ডেস্ক: সদ্য মুম্বই সিটি এফসি শিবিরে যোগ দিয়ে প্রথম ম্যাচেই নায়ক হয়ে উঠলেন স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড ইকের গুয়ারৎজেনা। মঙ্গলবার তাঁর গোলেই জয়ে ফিরল মুম্বইয়ের দল। ঘরের মাঠে রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে গেলেও প্রতিপক্ষকে গোলের ব্যবধান বাড়াতে দেয়নি ইস্টবেঙ্গল রক্ষণ। অসাধারণ ডিফেন্সিভ ফুটবল খেললেও গোলের দরজা খুলতে পারেননি নাওরেম মহেশরা। সারা ম্যাচে একটিও শট তারা গোলে রাখতে পারেনি। ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ক্লেটন সিলভার অনুপস্থিতিতে তাদের আক্রমণ বিভাগ দিশাহারা হয়ে পড়ে।
এই নিয়ে টানা ছ’টি ম্যাচে জয়হীন হয়ে থাকল কলকাতার দল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নর্থইস্ট ইউনাইটেডকে ৫-০-য় হারানোর পর থেকে জয়ের মুখ দেখেনি লাল-হলুদ বাহিনী। শেষ ছয় ম্যাচে চার গোল দিয়ে ছ’গোল খেল তারা। গোলপার্থক্যও নেমে এল একে। ফলে লিগ টেবলের দশ নম্বরে নেমে গেল কলকাতার দল। অন্য দিকে, সাত নম্বর জয় পেয়ে ২৫ পয়েন্ট নিয়ে চার নম্বরে মুম্বই সিটি এফসি। তাদের চেয়ে দু’পয়েন্ট কম পেয়ে মোহনবাগান এসজি রয়েছে তাদের পরেই। বুধবার এফসি গোয়াকে হারাতে পারলে অবশ্য ফের মুম্বইকে টপকে যাবে সবুজ-মেরুন শিবির।
এ দিন সারা ম্যাচে ৭০ শতাংশ বল ছিল মুম্বইয়ের খেলোয়াড়দের পায়ে। প্রতিপক্ষককে বল ধরতে না দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই নেমেছিল তারা। প্রথমার্ধে সেই পরিকল্পনায় সফল হয় তারা। ২৪ মিনিটের মাথায় গুয়ারৎজেনার অসাধারণ গোলে এগিয়ে যায় গতবারের লিগশিল্ডজয়ীরা। তার পর ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমণ করলেও ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণে বারবার আটক হয়ে যায় তারা।
ইস্টবেঙ্গলও গুটিকয়েক প্রতি আক্রমণ করে। কিন্তু কোনওটিরই পরিণতি ইতিবাচক হয়নি। একটিও শট তারা তিনকাঠির মধ্যে রাখতে পারেনি। প্রভসুখন গিল যেখানে দু’টি অনবদ্য সেভ করেন, সেখানে তাঁর প্রতিপক্ষের গোলকিপার ফুর্বা লাতচেনপাকে এ দিন একটিও সেভ করতে হয়নি। প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে মুম্বই যেখানে ৩২বার বলে পা ছোঁয়ায়, সেখানে ইস্টবেঙ্গল অপর প্রান্তের বক্সে ঢুকে ১১বারের বেশি পা ছোঁয়াতে পারেনি। তাদের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলা ফেলিসিও ব্রাউন ও নন্দকুমার শেখর যে সুযোগ হাতছাড়া করেন, তার চেয়ে ভাল সুযোগ এই ম্যাচে আর পাওয়ার কথাও ছিল না তাঁদের।
তিন দিন আগেই গুয়াহাটিতে ম্যাচ খেলে ইস্টবেঙ্গল। তাই এ দিন হাফ ডজন পরিবর্তন করে প্রথম এগারো নামান কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। ৫-৪-১-এ দল সাজান তিনি। এই ছক দেখেই আন্দাজ করা গিয়েছিল, রক্ষণাত্মক ফুটবল দিয়েই শুরু করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। মুম্বইও চারটি পরিবর্তন করে এ দিন দল নামায়। ৪-১-৪-১-এ দল সাজায় তারা।
কিন্তু খেলা শুরু হতেই পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়ে লাল-হলুদ বাহিনী। প্রথম দশ মিনিটে মুম্বইয়ের বল পজেশন ছিল ৮১%। ম্যাচের মিনিট কুড়ির মধ্যে দশটি ক্রস দেয় মুম্বই ও তিনটি শট নেয় তারা। লক্ষ্যে ছিল একটি। পাঁচ মিনিটেই ইকেরের গোলমুখী কোণাকুনি শট কাছের পোস্টের সামনে বাঁচান গিল। এর পর রাহুল ভেকে, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে, আকাশ মিশ্র, জয়েশ রাণে, তিরি, বিক্রম প্রতাপ-রা ঘন ঘন আক্রমণ করেন। তখন ইস্টবেঙ্গলের দূর্গরক্ষা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।
তারা ম্যাচের প্রথম কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠে ১৯তম মিনিটে। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে মুম্বইয়ের বক্সে ঢুকে পড়েন সদ্য দলে যোগ দেওয়া জার্মান স্ট্রাইকার ফেলিসিও ব্রাউন। দৌড়ের সময় বাঁদিক দিয়ে সমানে তাঁকে অনুসরণ করেন নাওরেম মহেশ সিং। কিন্তু বক্সে ঢোকার পর তাঁকে বল দিতে যান ব্রাউন, যা ব্লক করে দেওয়া হয়। বাকি সময় সমানে দুই উইং দিয়ে আক্রমণ করে যায় মুম্বই। প্রচুর পাস খেলে বলের পজেশন বজায় রেখে প্রায়ই আক্রমণে ওঠে তারা।
এক ঝাঁক আক্রমণের পর ২৪ মিনিটের মাথায় লকগেট খোলেন সদ্য মুম্বই শিবিরে যোগ দেওয়া স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড ইকের গুয়ারৎজেনা। বাঁ দিক থেকে আকাশ মিশ্র কাট ব্যাক করেন বক্সের সামনে বাঁদিকে থাকা আলবার্তো নগুয়েরাকে। তাঁর ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে বল পেয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গোলে বল ঠেলে দেন ইকের (১-০)। গোলে শট নেওয়ার সময় তাঁকে ঘিরে ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের চার ফুটবলার। তবু তার মধ্যে থেকেই গোলে বল ঠেলে দেন জানুয়ারির দলবদলের শেষ দিনে যোগ দেওয়া এই ফুটবলার।
এ দিনই প্রথম মুম্বইয়ের জার্সি গায়ে খেলতে নেমেছিলেন ইকের। প্রথম ম্যাচেই অসাধারণ খেলেন তিনি। ২২-২৩ মরশুমে এফসি গোয়ায় খেলার পর চলে যান স্পেনের তৃতীয় ডিভিশনে খেলতে। সেখান থেকে সদ্য মুম্বইয়ে যোগ দেন তিনি এবং প্রথম ম্যাচেই হয়ে ওঠেন নায়ক। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতে নেন তিনি।
এই গোলের পরও তাঁর একটি গোলমুখী শট বারে লাগে, কিন্তু তার আগেই রেফারি অফসাইডের বাঁশি বাজান। এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর প্রথমার্ধের বেশিরভাগ সময় নিজেদের পায়েই বল রেখে নাগাড়ে পাস খেলে যান মুম্বইয়ের ফুটবলাররা। প্রতিপক্ষকে বল ধরার সুযোগই কার্যত দেননি তাঁরা। প্রথমার্ধে পাস (৩২১-১৩৬) ও ক্রসের সংখ্যাতেও (১৬-৩) অনেক এগিয়ে ছিল মুম্বই সিটি এফসি। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত তা বজায় ছিল (নীচে পরিসংখ্যান দেখুন)।
বিরতির পর লালচুঙনুঙ্গা ও পিভি বিষ্ণুকে নামান কুয়াদ্রাত। তুলে নেন এডুইন ভন্সপল ও ভিপি সুহেরকে। এই পরিবর্তনের পর তাও কিছুটা খোলস ছেড়ে বেরোতে দেখা যায় ইস্টবেঙ্গলকে। কিন্তু আক্রমণের শেষে বারবার খেই হারিয়ে ফেলেন বিষ্ণু-ব্রাউনরা। ৭০ মিনিটের মাথায় হলুদ কার্ড দেখেন চুঙনুঙ্গা, যার ফলে পরের ম্যাচে তিনি খেলতে পারবেন না। ৮০ মিনিটের মাথায় হলুদ কার্ড দেখেন মহেশও। তিনিও পরের ম্যাচে খেলতে পারবেন না। অর্থাৎ, পরের ম্যাচেও (শনিবার হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে) দল বাছাই নিয়ে সমস্যায় পড়তে চলেছে লাল-হলুদ শিবির।
অন্য দিকে, মুম্বইয়ের আক্রমণ ছিল অব্যহত। ইকেরকে কেন্দ্র করে সমানে আক্রমণ করে যান ছাঙতে, বিক্রমরা। তাঁদের আটকাতে মাহের, নিশুরা হিমশিম খেয়ে গেলেও সহাল ছাড়েননি। ৬১ মিনিটের মাথায় সমতা আনার উদ্দেশ্যে নন্দকুমার শেখর ও ভিক্টর ভাজকেজকে নামান কুয়াদ্রাত। ফলে এ বার তাদের আক্রমণও কিছুটা তীব্র হয়।
কিন্তু ৭৪ মিনিটের মাথায় যে সুযোগ হাতছাড়া করেন নন্দকুমার, এর চেয়ে ভাল সুযোগ এই ম্যাচে পাওয়ার কঠিন। বাঁ দিক থেকে মহেশের নিখুঁত ক্রস যখন বক্সের মধ্যে পেয়ে যান নন্দ, তখন বল রিসিভ করতেই এত সময় নিয়ে নেন তিনি যে, তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নিতে অসুবিধা হয়নি আকাশ মিশ্রর। বল পেয়েই প্রথম টাচে শট নিলে হয়তো গোল পেতেন নন্দ।
এর পরে বিষ্ণু দু-দু’বার গোলের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে কোনওবারই গোল হওয়ার মতো জায়গায় বল পাঠাতে পারেননি তিনি। ব্রাউন ও ভাজকেজও শেষ দিকে মুম্বইয়ের দুর্ভেদ্য রক্ষণে চিড় ধরাতে পারেননি। নির্ধারিত সময়ের শেষ মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সুযোগও পেয়ে যান ছাঙতে। কিন্তু তিনি তা কাজে লাগাতে পারেননি। আটকে দেন গোলকিপার গিল।
সাত মিনিট বাড়তি সময় পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি কোনও দলই। শেষ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে দূরের পোস্টের দিকে নেওয়া মহেশের ভলি মুম্বইয়ের গোলকিপার ফুর্বা লাচেনপা আটকে দিলেও বল ছিটকে আসে তাঁর সামনে। সেখানে হিজাজি মাহের থাকলেও তাঁর পক্ষে ওই বল গোলে রাখা কঠিন ছিল।
ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৫-৪-১): প্রভসুখন গিল (গোল), এডুইন ভন্সপল ( লালচুঙনুঙ্গা-৪৫), গুরসিমরাত গিল (ভিক্টর ভাজকেজ-৬১), হিজাজি মাহের, মন্দার রাও দেশাই, নিশু কুমার (মহম্মদ রকিপ-৭৭), ভিপি সুহের (পিভি বিষ্ণু-৪৫), অজয় ছেত্রী (নন্দকুমার শেখর-৬১), শৌভিক চক্রবর্তী, নাওরেম মহেশ সিং, ফেলিসিও ব্রাউন।





