অলস্পোর্ট ডেস্ক: একুশ বছরের বর্ণময় ফুটবল জীবনের ইতি টেনেছেন বেশ কয়েকদিন হল, তিনি বাংলার ছেলে আন্তর্জাতিক গোলকিপার সুব্রত পাল । ফুটবল মাঠে সাফল্য, ব্যর্থতা তো ছিলই তাঁর, ছিল গ্লানিও। সে সব পিছনে ফেলে রেখেই আর ফুটবল মাঠে না নামার সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা গোলকিপার।
অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনে হয়েছে অবসর নেওয়ার এটাই সেরা সময়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। ফুটবলই আমার কাছে সবকিছু। তাই ফুটবল থেকে অবসরের সিদ্ধান্তটা নেওয়া আমার পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু একটা সময় তো ইতি টানতেই হয়। তাই সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম”।
টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা ভারতীয় দলের এই প্রাক্তন গোলকিপার মোহনবাগানেই ক্লাব ফুটবলের কেরিয়ার শুরু করেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ তিনি ইস্টবেঙ্গলের গোল সামলান। পরে পুণে এফসি, প্রয়াগ ইউনাইটেডের মতো একাধিক নামী ক্লাবের হয়েও খেলেন তিনি। ডেনমার্কের একটি ক্লাবেও (ভেস্তসেলান এফসি) যোগ দেন তিনি। তবে মাঠে নামার সুযোগ পাননি।
ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ৯৫টি ম্যাচ খেলেছেন ৩৫ বছরের সুব্রত। ২৮টি ক্লিন শিট রয়েছে তাঁর নামের পাশে। আইএসএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ক্লিন শিটের তালিকায় তাঁর এই কীর্তি ছ’নম্বরে রয়েছে। সেভের সংখ্যার দিক থেকেও তিনি প্রথম পাঁচে রয়েছেন। আইএসএলে সব মিলিয়ে ২৬৯টি গোল বাঁচিয়েছেন তিনি। ২০১৪-য় মুম্বই সিটি এফসি-র হয়ে এই লিগে অভিযান শুরু করেন তিনি। এর পরে তিনি নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ও জামশেদপুর এফসি-র হয়েও খেলেন। ২০১৭-১৮ মরশুমে সাতটি ক্লিন শিট রেখে ও ৫০টি সেভ করে গোল্ডেন গ্লাভ পুরস্কার পান তিনি।
সেই মরশুমই ছিল আইএসএলে তাঁর সেরা মরশুম। সে বার তাঁর সেভ পার্সেন্টেজ ছিল ৭৭%, যা ছিল সর্বোচ্চ। সারা মরশুমে ১৮০টি বল রিকভারি করেছিলেন, যা ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তিনি অসাধারণ ফর্মে থাকলেও সে বার তাঁর দল জামশেদপুর এফসি নক-আউটে উঠতে পারেনি। কেরিয়ারের শেষ দিকে হায়দরাবাদ এফসি, ইস্টবেঙ্গল এফসি ও তৎকালীন এটিকে মোহনবাগানের হয়েও খেলেন বাংলার এই গোলকিপার।
আই লিগেও ৬০টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। একসময়ে ভারতীয় দলের নিয়মিত গোলকিপার ছিলেন তিনি। তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্সের জন্য তাঁকে অনেকে ভারতের ‘স্পাইডারম্যান’ বলেও ডাকা হয়। জাতীয় দলের হয়ে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ, সাফ কাপ ও একটি ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়নের খেতাব জেতেন। এএফসি এশিয়ান কাপেও ভারতের হয়ে ছ’টি ম্যাচ খেলেছেন বাংলার এই তারকা ফুটবলার।
ভারতের সব বয়সভিত্তিক দলের হয়েই খেলেছেন সুব্রত। প্রি অলিম্পিক বাছাই পর্বে অনুর্ধ্ব ২৩ ভারতীয় দলের হয়ে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েই সবার নজর কাড়েন তিনি। মায়ানমারের বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুট আউটে তিনটি সেভ করে ভারতকে গ্রুপ পর্বে তুলেছিলেন তিনি। ২০০৭-এ সিনিয়র জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন এই অর্জুন পুরস্কারে ভূষিত গোলকিপার। ১৯টি ম্যাচে কোনও গোল হজম করেননি। ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১২-র নেহরু কাপজয়ী ভারতীয় দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। ভারতের অধিনায়কত্বও করেছেন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন ২০১৫-য়। ২০১৭-য় ত্রিদেশীয় কাপে শেষ ভারতীয় দলের হয়ে মাঠে নামেন তিনি।
নিজের ফুটবলজীবন নিয়ে তিনি বলেন, “আমি নিজের ফুটবল জীবন নিয়ে গর্বিত। এএফসি এশিয়ান কাপ-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা আমার কাছে বিরাট সন্মানের। সাফল্যের শিখর থেকে ব্যর্থতার অন্ধকার, সবই দেখেছি। জীবনের এই চড়াই-উতরাই নিজেকে ফুটবলার ও মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অনেক সাহায্য করেছে”।
যে বছর প্রথম মোহনবাগানে সই করেন সুব্রত, সে বছর বেঙ্গালুরুতে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে তাঁর সঙ্গে প্রবল সঙ্ঘর্ষের ফলে প্রাণ হারান ডেম্পোর ব্রাজিলীয় ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র। সেই ঘটনার পর তাঁর ফুটবল জীবনে কার্যত অন্ধকার নেমে আসে। অনেকেই তাঁকে এই ঘটনার জন্য কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। কিন্তু ক্রমশ নিজেকে গ্লানির অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরিয়ে আনেন সুব্রত।
ডোপিং বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে নির্বাসিতও হয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসকের নির্দেশে নিষিদ্ধ ওষুধ খেয়ে নির্বাসিত হলেও পরে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে নির্বাসনমুক্ত হন সুব্রত। সব বাধা অতিক্রম করে নিজেকে বারবার ফুটবল মাঠে ফিরিয়ে আনেন তিনি। অবসর ঘোষণার পর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-কে তিনি বলেছেন, “ফুটবলজীবনে এমন কোনও ঘটনা নেই, যা এখনও আমাকে যন্ত্রণা দেয়। অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শক্তিশালী হয়েছি”।
ফুটবল জীবন শেষ করার পরে এ বার ভারতীয় ফুটবলের উন্নতিতে সাহায্য করতে চান সুব্রত পাল। অবসর জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এ বার ফুটবলের বাইরে আগ্রহের বিষয়গুলি অন্বেষণ করতে চাই। নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের সাহায্য করতে চাই। ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির জন্য কিছু করার ইচ্ছেও রয়েছে”।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সুব্রত বলেন, “আমার কাছে সফল হওয়ার তিনটেই মন্ত্র। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং লক্ষ্য নির্ধারণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই তিনটি জিনিস মেনে চললে সফল হতে পারব”। সারা জীবন এই মন্ত্র নিয়েই ফুটবলার জীবনে চলেছেন এবার কোন পথ বেছে নেন সেটাই দেখার।
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার