সুচরিতা সেন চৌধুরী: কিছু মুহূর্ত সব সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। কিছু মুহূর্ত ধরা থাকে মনের ফ্রেমে। যা এদিন দেখল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। এভাবে পুরো গ্যালারির দখল এর আগে একটা দলের সমর্থকদের নিতে দেখা যায়নি। এদিন যেটা করে দেখাল মোহনবাগান সমর্থকরা। অন্যদিকে মাঠে শুরু থেকে জয়ের খেলাটাই খেলল সবুজ-মেরুন দল। লিগশিল্ড চ্য়াম্পিয়ন হতে গেলে এই ম্যাচ জিততেই হত মোহনবাগানকে। মুম্বই সিটির সামনে ছিল ড্রয়ের সুযোগ। ঘরের মাঠে আইএসএল ২০২৩-২৪-এর লিগ পর্ব ২-১ গোলে জিতেই শেষ করল কলকাতার দল। ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই যুবভারতীর গ্যালারিতে অকাল দীপাবলি। জ্বলল মশাল, ফাটল বাজি সঙ্গে ৬১ হাজার ৭৭৭-এর গ্যালারির আবেগের বিস্ফোরণ।
ম্য়াচ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোলের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করেন সাদিকু। ২০ মিনিটে আবারও সুযোগ আসে মোহনবাগানের সামনে। এবার গোলের কারিগর হিসেবে নাম লেখাতে পারতেন লিস্টন কোলাসো। বক্সের মধ্যে থেকে তাঁর জোড়াল শট দারুণ দক্ষতায় বাঁচিয়ে দেন মুম্বই গোলকিপার টেম্পা লাচেনপা। তবে গোলের সামনে গিয়ে গোল না পাওয়ার যন্ত্রণাটা যে লিস্টনের যায়নি তার প্রমাণ পাওয়া গেল আট মিনিটের মধ্যেই।
যে গোলটি লিস্টন কোলাসো করলেন সেটা যে শুধু মোহনবাগানকে এগিয়ে দিল তা নয়, এক কথায় দৃষ্টি নন্দন ফিনিশিং। যা বাঁচানোর কথা হয়তো ভাবতেই পারেননি আগের নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে দেওয়া মুম্বই গোলকিপার। ম্যাচের বয়স তখন ২৮ মিনিট। দিমিত্রি পেত্রাতোসের সঙ্গে পাস খেলে বক্সে পৌঁছে গিয়েছিলেন লিস্টন। বক্সের বাইরে থেকে দিমিত্রি সেই বলই বক্সের মধ্যে ফেরত পাঠিয়েছিলেন লিস্টনকে লক্ষ্য করে। বল ধরেই যে গতিতে লিস্টন গোলে শট নিয়েছিলেন তা যেন গোলার মতো ঢুকে গেল গোলে।
দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দলের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এক তো ব্যবধান ধরে রাখার চাপ। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের সমতায় ফেরার চাপ সামলানো। এই দুই চাপে ভুল হয়ে যায় অনেক। মোহনবাগান যে গতিতে শুরু করেছিল সেই গতিটা প্রথমার্ধে গোল করার পর হারিয়ে গেল। গোল তো আর হলই না, তৈরিও হল না সুযোগ। দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কিছু পরিবর্তন করলেন হাবাস। অভিষেকের জায়গায় দীপক, সাদিকুর জায়গায় কামিংস, কাউকোর জায়গায় হামিলকে এনে খেলার গতি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন।
৫০ মিনিটে কিছুটা থমকে গেল খেলা। বল দখলের লড়াইয়ে লাফিয়েছিলেন সাদিকু ও মুম্বইয়ের তিরি। মাথায় মাথায় ধাক্কায় দু‘জনেই ছিটকে পড়েন মাঠে। গুরুতর আহত হন তিরি। প্রাথমিক চিকিৎসার পর মাঠে ফিরলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। সাপোর্ট স্টাফদের কাঁধে ভর দিয়ে তাঁকে মাঠ ছাড়তে দেখা যায়। তখনও ১-০ গোলে এগিয়ে মোহনবাগান। ব্যবধান ধরে রাখার অদম্য লড়াই চালাচ্ছে তখন মোহনবাগান। একদিকে মুম্বইয়ের সমতায় ফেরার লড়াইয়ে বার বার সবুজ-মেরুন বক্সে হানা। রক্ষণ সামলাতে কখনও কখনও পুরো দল নেমে যাচ্ছিল নিচে। তার মধ্যেই পরিবর্তন কাজে দিল হাবাসের।
জেসন কামিংস বক্সের মধ্যে প্রথমে বলটা মিস করলেও সামলে নেন সঙ্গে সঙ্গেই। তার পর সেই বলের উপর কন্ট্রোল রেখেই গোলে শট নেন বক্সের বাঁদিক থেকে। কিছু করার ছিল না মুম্বই গোল কিপারের। ৮০ মিনিটে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়ে অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে মোহনবাগান কোচ। যার ফল এক সঙ্গে জোড়া পরিবর্তন করলেন তিনি। লিস্টনের জায়গায় আশিস রাই ও থাপার জায়গায় হামতেকে নামিয়ে দিলেন শেষ মুহূর্তে। আর ৮৯ মিনিটে গোল হজম করে বসল মোহনবাগান। ভাগ্যিস দুই গোলের ব্যবধান ছিল। না হলে বিপদ অনেকটাই বেড়ে যেত। এদিন গোলের নিচে অনবদ্য বিশাল কাইথ। তিনি না থাকলে ফল অন্যরকমও হতে পারত।
৮৯ মিনিটে রালতের হেড থেকে ছাংতের গোলে ২-১ করল মুম্বই সিটি এফসি। তখনও বাকি ছিল অনেক নাটক। মোহনবাগান-মুম্বই ম্যাচে যেমনটা হয়ে থাকে। একাধিক হলুদ কার্ড তো ছিলই সঙ্গে লাল কার্ডও বাদ গেল না। আট মিনিটের অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে দুটো হলুদ কার্ডের জন্য লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন মোহনবাগানের ব্রেন্ডন হামিল। ১০ জনের মোহনবাগানের সামনে তখন শুধু ব্যবধান ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। তাও বল দখলের লড়াইয়ে দুই দলের ফুটবলাররা মধ্যে রীতিমতো হাতাহাতিতে জরিয়ে পড়লেন। রেফারি অবশ্য আর লাল কার্ড বের করেননি। হলুদ কার্ডেই কাজ সারলেন।
আট মিনিটের অতিরিক্ত সময়ে যেন বার বার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল গ্যালারি। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত নার্ভ ধরে রেখে জিতেই মাঠ ছাড়ল দল। শেষ বাঁশি বাজতেই ভেঙে গেল সব উচ্ছ্বাসের বাধ। রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে রীতিমতো ছুটে গেলেন ফুটবলার সাপোর্ট স্টাফরা। গ্যালারি থেকে নেমে এলেন সামাদ, কিয়ানরা। আজ আর ম্যাচ শেষ হতেই গ্যালারি ফাঁকা হয়ে গেল না। ঘড়ির কাটা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে রাত ৯.৪০-এর ঘর। কিন্তু দলের সাফল্য, দলের হাতে ট্রফি ওঠার মুহূর্তটা দেখার জন্যই তো সব উত্তেজনা, সব লড়াই। ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, কিছু মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরা যায় না থেকে যায় মনের ফ্রেমে। এটাও তেমনই একটা মুহূর্ত যা অবশ্যই ধরা থাকবে ক্যামেরায় কিন্তু অনুভূতিটা থেকে যাবে মনের ফ্রেমে।
মোহনবাগান: বিশাল কাইথ, শুভাশিস বোস, হেক্টর ইউয়েস্তে, আনোয়ার আলি, অভিষেক সূর্যবংশী (দীপক টাংরি), অনিরুদ্ধ থাপা (লালরিনলিয়ানা হামতে), জনি কাউকো (ব্রেন্ডন হামিল), লিস্টন কোলাসো (আশিস রাই), মনবীর সিং, আর্মান্দো সাদিকু (জেসন কামিংস), দিমিত্রি পেত্রাতোস
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার