সুচরিতা সেন চৌধুরী: ছোটবেলা থেকেই মনে হত, নিজের পক্ষে যেটা সম্ভব মনে হয় সেটার বাইরে বেরিয়ে নিজেকে প্রমান করতে হবে। এই খিদেটাকে সঙ্গে করেই টেবল টেনিসের বোর্ডে হাতেক্ষরী। পরিবার থেকে শিক্ষক, প্রতিমুহূর্তে তাঁর এই লড়াইয়ের মমানসিকতাটাকে উসকে দিয়েছেন। আর হয়তো সে কারণেই বাংলার ঐহিকা মুখোপাধ্যায় এখন সবার মুখে মুখে ঘুরছেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার এই কলকাতা শহর থেকে অনেক কিলোমিটার দূরে একটা মেয়ে গড়ে ফেলেছিলেন ইতিহাস। হারিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বের এক নম্বরকে। শনিবার সেই ঐহিকাকেই সংবর্ধনা দিল তাঁর তারকা টেবল টেনিস হয়ে ওঠার মঞ্চ ধানুকা ধানসিঁড়ি সৌমদীপ-পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি।
এদিন তাঁর হাতে একলক্ষ টাকার চেক তুলে দেন সিকে ধানুকা। তিনি বলেন, “আমি যা করি তা দেশের স্বার্থে করি। ক্রিকেট, ফুটবল নিয়ে তো সবাই ভাবে। কিন্তু দাবা, টেবল টেনিসকে সামনে রেখে যে বড় কর্মকাণ্ড শুরু করেছি সেটা শুধুই দেশের কথা ভেবে। অলিম্পিকে পদক চাই। আসল সাফল্য তো ওটাই।” আর এই স্বপ্নই দেখাচ্ছেন এই অ্যাকাডেমির দুই কন্যা ঐহিকা মুখোপাধ্যায় ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়. এঁরা কখনও এককভাবে আবার কখনও যৌথ উদ্যোগে দেশকে সাফল্য এনে দিচ্ছেন।
এশিয়ান গেমসে জুটিতে ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন ঐহিকা-সুতীর্থা। খুব বেশিদিন গড়ায়নি সেই ঘটনার আর বছরের শুরুতেই আরও একটা অঘটন ঘটালেন এই জুটিরই একজন। তিনি ঐহিকা। এই মাসেই তিনি হারিয়ে দিয়েছেন বর্তমান বিশ্বের এক নম্বরকে। ওয়ার্ল্ড টিম চ্যাম্পিয়নশিপে সুন ইংশাকে ঐহিকা হারিয়ে দেন ৩-১-এ। ম্যাচের ফল ছিল ১২-১-, ২-১১, ১৩-১১, ১১-৬। ২০২৪-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে ইতিহাস লিখেছিলেন এই মেয়ে যা ভারতীয় টেবল টেনিসের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন।
এখনও শুভেচ্ছার জোয়াড়ে ভাসছেন ঐহিকা। সঙ্গে দৃঢ়তা তাঁর প্রতিটি শব্দে। বলছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই চাইছিলাম যেন আমার সঙ্গে ইংশারই খেলা পড়ে। আমি সেই মতো আর্জিও জানিয়েছিলাম টিম মিটিংয়ে। আমি বলেছিলাম এমন করে দলটা সাজানো হোক যাতে আমার খেলা ইংশার সঙ্গেই হয়। খেলার আগে দেখলাম আমি যেটা চেয়েছিলাম ঠিক সেটাই হয়েছে। আমি তাতে খুব খুশি হয়েছিলাম।”
তিনি সেই ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার চ্যালেঞ্জ নিতে ভাল লাগে। নিজের বয়সের ছেলে-মেয়েদের থেকে বেশি আমি বড়দের সঙ্গে বা যারা আমার থেকে ভাল তাদের সঙ্গে খেলতে চাইতাম। নিজের থেকে ভালদের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে আমি হার বা জয় নিয়ে ভাবি না। আমি তখন ভাবি কী ভাবে নিজেকে নিংড়ে দেব। আমি খেলাটাকে প্রচন্ড উপভোগ করি। এতটাই উপভোগ করে খেলি যে প্রতিপক্ষকে আমার থেকে পয়েন্ট কাড়তে হলে কষ্ট করতে হবে। লক্ষ্য রাখি নিজে যাতে এমন কোনও ভুল না করি যাতে পরে তা নিয়ে আফশোস করতে হয়। সেদিনও ঠিক তাই হয়েছিল।”
মেনে নিলেন, ইংশা তাঁর থেকে অনেক ভাল প্লেয়ার হলেও সেদিনটা তিনি সেই টাচে ছিলেন না। আর ঐহিকার উপর যেন টেবল টেনিস দেবতাই স্বয়ং ভর করেছিলেন। বাকিটা তো ইতিহাস। যা টেবল টেনিস দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল। তিনি এশিয়ান গেমসে জয়ের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “একক আর ডাবলসের মধ্যে অনেক পার্থক্য সেটা হল সিঙ্গলসে একা খেলতে হবে আর ডবলসে আমার পার্টনার আমার সঙ্গে থাকবে, তবে মানসিকতাটা একই থাকে। এশিয়ান গেমসেও আমরা যাদের হারিয়েছিলাম তাদের মধ্যে টপ ফোরের প্লেয়ার ছিল, প্রাক্তন ওয়ার্ল্ড নম্বর এক ছিল, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধেও আমরা হার-জিতের কথা না ভেবেই খেলতে নেমেছিলাম এবং ফল পেয়েছিলাম।”
তবে ঐহিকা এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন যে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই তাঁরা ‘বাই চান্স’ জিতেছেন। তিনি বলছিলেন, “এটা ভাববেন না যে আমরা বাই চান্স জিতেছি। আমাদের এখানে অনেক প্রতিভা রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরা পারব করতে। আমাদের খেলার স্টাইলও অনেক আলাদা। আর যদি হারিও তাহলেও যেন ওরা বাইরে গিয়ে বলে লড়াই করতে হয়েছে।”
এতটাই আত্মবিশ্বাসী বাংলার এই মেয়ে। কয়েকদিনের মধ্যেই উড়ে যাবেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকবেন তাঁর ডবলস পার্টনার সুতীর্থাও। ডবলসের পাশাপাশি সিঙ্গলসও রয়েছে সেখানে। তবে যে উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন এই মেয়ে তাতে তাঁকে ঘিরে যে কোনও প্রতিযোগিতায় প্রত্যাশা তো থাকবেই।
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার