অলস্পোর্ট ডেস্ক: এশিয়ান গেমস ২০২৩-এ তিনি মেলালেন ফেলে আসা ইতিহাসকে. হারমিলন বেইন্সের জন্ম হয়েছিল দৌঁড়নোর জন্যই। আর হবে নাই বা কেন? হারমিলনের রক্তেই রয়েছে দৌঁড়। বাবা-মা দু’জনেই যে বার বার অ্যাথলেটিক্সে দেশকে সম্মান এনে দিয়েছিলেন তাঁদের মেয়ে যে অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাকে সোনা ফলাবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে সোনা না পেলেও এশিয়ান গেমস ২০২৩-এ জোড়া রুপো জিতে নিয়েছেন এই মেয়ে।
তাঁকে এমন ব্যাঙ্গের শিকারও হতে হয়েছে, যে তিনি নাকি তাঁর মায়ের গর্ভেই প্রথম দৌঁড় শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই কথার পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস। হারমিলনের কাহিনী এখন সবার মুখে মুখে ঘুরছে। কী সেই গল্প?
হারমিলন বেইন্সের মা মাধুরী সিং যখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তখন তিনি পঞ্জাব স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরির জন্য ১৫০০ মিটার ট্রায়ালে নেমেছিলেন। সেটা ৯০-এর দশকের ঘটনা। সেদিন সেই ট্রায়ালে না নামলে তাঁর চাকরিটা হত না। শেষ পর্যন্ত অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি ট্রায়ালে নেমে সফল হয়ে চাকরিটা ধরে রাখেন। এবং তার ছ’মাস পর ২৩ জুলাই ১৯৯৮-এ হারমিলন বেইন্সের জন্ম হয়।
পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরে জন্ম হয় হারমিলনের। তাঁর জন্মের চার বছর পর বুসান এশিয়ান গেমসে মহিলাদের ৮০০ মিটারে রুপো জেতেন তিনি। সেই ৮০০ মিটারেই ২০২৩ হ্যাংঝৌ এশিয়ান গেমসে রুপো জিতলেন হারমিলন। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর এই সাফল্য। ২০০৩-এ অর্জুন পুরস্কার পান মাধুরী সিং।
শুধু কি মা? বাবাও কিন্তু অ্যাথলেটিক্সের একজন দিকপাল। আমনদীপ বেইন্স তাঁর সময়ের একজন বিখ্যাত রানার ছিলেন। আমনদীপ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের পদক বিজয়ী এবং একজন প্রাক্তন ১৫০০ মিটার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। মায়ের দেখানো পথে যখন ৮০০ মিটারে রুপো জিতে নেন মেয়ে হারমিলন তখন বাবার দেখানো ১৫০০ মিটারের দীর্ঘ ট্র্যাকও একইভাবে লড়ে রুপো এনে দেন তিনি। একসঙ্গে বাবা ও মা-র দু’জনেরই দেখানো পথে দৌঁড়ে সফল তিনি।
অ্যাথলেটিক্স বেইন্স পরিবারের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। হারমিলন তাই জন্মের পর থেকেই অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। তাই তিনি যে এই পথেই যাবেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি অন্য কোনও পেশা বেছে নিলে অবাক হতে হত।
ছোটবেলায় হারমিলন বেইন্স স্থানীয় খেলার মাঠে ছেলেদের সঙ্গে রেস করতেন। তিনি তাঁর প্রথম প্রতিযোগিতামূলক দৌঁড়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। তখন তাঁর তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু দ্বিতীয় হয়ে খুব ফভেঙে পড়েছিলেন সেই ছোট্ট মেয়ে। ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন অ্যাথলেটিক্স। কিন্তু তাঁর মাকে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং মেয়েকে খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন। হারমিলন তার পর থেকে পর পর জিতে আবার ফিরে আসেন।
অ্যাথলেটিক্সকে কেরিয়ার করার কথা কখনও ভাবেননি তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিল পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার। তবে এই পঞ্জাব রানারের কাছে পরিবারের প্রত্যাশা সবসময়ই ছিল যে তিনি অ্যাথলেটিক্সে কিছু করবেন।
“সব সময় একটা প্রত্যাশা থাকে যে আমার বাবা-মা অনেক কিছু অর্জন করেছেন, এমনকি আমাকেও একই পথে যেতে হবে। আমাকে কখনওই জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে আমি কী করতে চাই। আমাকে দৌঁড়তে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল,” হারমিলন বেইন্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন।
১৩ বছর বয়সে, হারমিলন বেইন্স একটি বড় ধাক্কা খায়। অনূর্ধ্ব-১৪ ইভেন্টের সময় ডোপ পরীক্ষার ফল পজেটিভ আসো এবং দুই বছরের জন্য নির্বাসিত হন। একজন স্থানীয় ডাক্তার তাকে টনসিলাইটিসের ওষুধ দিয়েছিলেন কিন্তু ন্যাশনাল অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সি প্যানেলের সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হলে তিনি হাজির হননি।
এই বিষয়ে হারমিলন বলেন, “আমি তখন খুব অসুস্থ ছিলাম। আমার কোনও কোচ ছিল না। সেই বয়সে কেউ কি জেনে শুনে স্টেরয়েড খেতে পারে? যখন ডাক্তারের তার বক্তব্য রাখার সময় এল তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে গেলেন। এমনকি তিনি তার ডিগ্রিও দেখাতে পারেননি। এটি আমার জন্য একটা ধাক্কা ছিল। আমি দু’বছর হারিয়েছি।”
হারমিলন অবশ্য এই ঘটনা পর আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন। ২০১৫ সালে, তার বাবা তাঁকে ধর্মশালায় স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সাই) হস্টেলে ভর্তি করে দেন এবং এটিই ছিল তাঁর কেরিয়ারের বড় মাইলস্টোন। এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু তাঁর।
সাইয়ে যোগ দেওয়ার কয়েক মাস পরে, হারমিলন বেইন্স সিবিএসই ন্যাশনালসে ১৫০০ মিটারে সোনা জেতেন। হারমিলন স্বীকার করে নেন, এই সোনাই তাঁকে অ্যাথলেটিক্সের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করেছিল। প্রথমে কোচ জসবিন্দর সিং ভাটিয়ার অধীনে এবং তারপর সুরেশ কুমার সাইনির অধীনে, হারমিলন বেইন্স পরবর্তী কয়েক বছরে দারুণভাবে উঠে আসেন।
২০১৫ সালে রাঁচি অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটার এবং ১৫০০ মিটার উভয় প্রতিযোগিতাতেই রুপো জয়ের পর, হারমিলন বেইন্স ভিয়েতনামে এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের ১৫০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জিতে ২০১৬ সালে তার আন্তর্জাতিক পদকের খাতা খোলেন। তিনি ইন্ডিয়ান গ্রাঁপ্রি-তে ৮০০ মিটারে রুপো জেতেন।
২০১৭ সালে হাঁটুর চোট তাঁকে আবার অনেকটা পিছিয়ে দেয়। এই চোট থেকে সেরে উঠতে এক বছর সময় লেগে যায় তাঁর। যার ফলে বেশ কিছু বড় ইভেন্ট তিনি মিস করে যান। ২০১৯-এ, তিনি সম্পূর্ণ ফিটনেস ফিরে পেয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা (১৫০০ মিটার) এবং একটি ব্রোঞ্জ (৮০০ মিটার) পান পাতিয়ালার ফেডারেশন কাপে। ২০২০ থেকে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সে শক্তিশালী প্রতিভা হিসেবে পাকাপাকি জায়গা করে নেন হারমিলন সিং।
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার





