অলস্পোর্ট ডেস্ক: চলতি মরশুমে যে রকম শুরু করেছে ইস্টবেঙ্গল, ইন্ডিয়ান সুপার লিগের গত মরশুমেও অনেকটা এ রকমই সূচনা করেছিল তারা। এ বার যেমন প্রথম আট ম্যাচের পর দুটি জয় ও তিনটি ড্র-সহ ৯ পয়েন্ট পেয়েছে তারা, গত বারও প্রথম আট ম্যাচের পর তিনটি জয়ে ৯ পয়েন্ট অর্জন করে তারা। গতবার এই পর্যায়ে পাঁচটি ম্যাচে হেরেছিল তারা, সেখানে এ বার হারের সংখ্যা তিন।
গতবার যেখানে প্রথম আট ম্যাচে ১১ গোল দিয়ে ১৪ গোল খেয়েছিল লাল-হলুদ বাহিনী, সেখানে এ বারও ১১ গোল দিয়েছে তারা। কিন্তু খেয়েছে আট গোল। গতবারের চেয়ে ফারাকটা এখানেই এবং এই ফারাকটাকেই উন্নতি বলে দাবি করছে ইস্টবেঙ্গল শিবির। কিন্তু এই উন্নতির ফলে অর্জন করা আত্মবিশ্বাস কি মুম্বই সিটি এফসি-র মতো শক্তিশালী দলকে হারানোর পক্ষে যথেষ্ট? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
গত ম্যাচে পাঞ্জাব এফসি-র সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে প্রথম ছয়ে প্রবেশ করে লাল-হলুদ ব্রিগেড। কিন্তু গত কয়েক দিন তাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে চেন্নাইন এফসি ও নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি। তাদের ফের টপকে সেরা ছয়ে ঢুকতে গেলে কার্লস কুয়াদ্রাতের দলকে ফের শনিবার জিততে হবে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে ইস্টবেঙ্গলকে, তারা চলতি লিগের অন্যতম কঠিন দল, যারা এখন পর্যন্ত সাতটি ম্যাচের মধ্যে একটিতেও হার মানেনি।
গতবারের লিগ চ্যাম্পিয়নদের এ মরশুমে এখন পর্যন্ত কেউ হারাতে পারেনি! তিনটি ম্যাচে তারা আটকে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাকি চারটি ম্যাচে জিতে লিগ তালিকার চার নম্বরে রয়েছে। মাঝে তাদের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে খেলতে হয় বলে আইএসএল থেকে ফোকাস হয়তো কিছুটা সরে গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ হারাতে পারেনি তাদের। সেই মুম্বই সিটি এফসি-কে আটকাতে বা হারাতে পারবে ইস্টবেঙ্গল এফসি?
যারা সম্প্রতি নর্থইস্টকে ৫-০-য় হারানোর পর পাঞ্জাব এফসি-র সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছে, তাদের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল এমন একটা দল, যাদের আগে থেকে বোঝা খুব কঠিন। তারা কোন ম্যাচে কতটা ভাল খেলবে বা খারাপ খেলবে, কারও পক্ষেই আগাম আন্দাজ করা সম্ভব না। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন মুম্বইয়ের দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ড্র করলেই সেটা হবে বড় অঘটন। কারণ, গত পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে দুটিতে ড্র করার পর যে মুম্বই সিটি এফসি জয়ে ফিরতে মরিয়া হয়ে উঠবেই এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সম্প্রতি কোচও বদলেছে তারা। এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডেস বাকিংহাম দায়িত্ব ছেড়ে দেন ও তাঁর জায়গায় আসেন চেক কোচ পেত্র ক্রাতকি, যিনি এর আগে ছিলেন মেলবোর্ন সিটি এফসি-র দায়িত্বে। আপাতত তাঁর তত্ত্বাবধানেই রয়েছে মুম্বই সিটি এফসি। নতুন কোচও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ও গতিময় ফুটবল পছন্দ করেন।
দলের পারফরম্যান্স
মুম্বই সিটি এফসি: পেরেইরা দিয়াজের জোড়া গোলে নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ২-১ জয় দিয়ে আইএসএল অভিযান শুরু করে গতবারের লিগশিল্ডজয়ীরা। পরের ম্যাচে ওডিশার বিরুদ্ধে ২-২-এ আটকে যায় তারা। এই ম্যাচেও গোল পান দিয়াজ। ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে তৃতীয় ম্যাচেও ২-১ জয়ে গোল পান তিনি। কিন্তু পরের ম্যাচে ফের ড্র! এ বার তথাকথিত দুর্বল হায়দরাবাদ এফসি-র বিরুদ্ধে। পাঞ্জাব এফসি-র বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত জয় তারা পায় ২-১-এ। বেঙ্গালুরু এফসি-র বিরুদ্ধেও ৪-০-য় জয়ে পেরেইরা দিয়াজের অবদান ছিল। কিন্তু এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ফের গোলশূন্য ড্রয়ে আটকে যায় মুম্বই সিটি এফসি। মোট ১৩ গোল দিয়ে ছ’গোল খেয়েছে তারা। এর মধ্যে বেশিরভাগ গোলই (৪) তারা দিয়েছে শেষ ১৫ মিনিটে। যা ইস্টবেঙ্গলের কাছে চিন্তার বিষয়। কারণ, শেষ ১৫ মিনিটে তারা ইতিমধ্যেই দুটি গোল হজম করে ফেলেছে। তবে সবচেয়ে বেশি (৩) গোল খেয়েছে ৬১ থেকে ৭৫ মিনিটের মধ্যে।
ইস্টবেঙ্গল এফসি: জামশেদপুরের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্রয়ের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ক্লেটন সিলভা ফর্মে ফেরেন। দলও জয়ে ফেরে। ব্রাজিলীয় তারকার জোড়া গোলে চলতি লিগের প্রথম জয় পায় তারা। বেঙ্গালুরুতে ফের ছন্দপতন হয় তাদের। ২-১-এ তাদের হারিয়ে লিগের প্রথম জয় পায় সুনীল ছেত্রীর দল। সে দিন হারার মতো না খেলেও হারতে হয় ইস্টবেঙ্গলকে। এর পরে এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে ৭৩ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থাকার পরে দু’মিনিটের মধ্যে পরপর দু’টি গোল খেয়ে ১-২-এ হেরে মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। কেরালা ব্লাস্টার্সের বিরুদ্ধে ফের ১-২-এ হারে লাল-হলুদ বাহিনী। এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ৮৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেন ক্লেটন সিলভা। চেন্নাইনের বিরুদ্ধেও ৮৫ মিনিট পর্যন্ত এক গোলে এগিয়ে থাকার পর গোল খেয়ে জেতা ম্যাচ ১-১ ড্র করে লাল-হলুদ বাহিনী। কিন্তু নর্থইস্টের বিরুদ্ধে তাদের ৫-০-য় জয় আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দেয় তাদের। সেই ম্যাচে জোড়া গোলের জোড়া নায়ক ক্লেটন ও নন্দকুমার শেখর পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে তেমন কিছুই করতে পারেননি, গোলশূন্য ড্র হয়।
ফুটবলারদের পারফরম্যান্স
মুম্বই সিটি এফসি: এ পর্যন্ত ছ’টি গোল করেছেন মুম্বইয়ের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার জর্জ পেরেইরা দিয়াজ। দলের প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল পেয়েছেন তিনি। গোলসংখ্যার দিক থেকে তাঁর ধারেকাছে নেই তাঁর সতীর্থরা। লালিয়ানজজুয়ালা ছাঙতে, আকাশ মিশ্র, গ্রেগ স্টুয়ার্ট, আবদেনাসের এল খয়াতি, লালেঙমাউইয়া রালতে ও রস্টিন গ্রিফিথ একটি করে গোল করেছেন। ছাঙতে ও স্টুয়ার্ট দুটি করে অ্যাসিস্ট করেছেন। এ ছাড়াও ফরোয়ার্ডদের মধ্যে বিক্রম প্রতাপ সিং, মিডফিল্ডার জয়েশ রানে, ডিফেন্ডার মেহতাব সিং একটি করে গোলে সহায়তা করেছেন। গোলের লক্ষ্যে শটের সংখ্যাতেও দিয়াজ সবার চেয়ে এগিয়ে। তাঁর মোট দশটি শট গোলে ছিল। তিনি ছাড়াও প্রতিপক্ষের অর্ধে সবচেয়ে তৎপর খেলোয়াড় গ্রেগ স্টুয়ার্ট। যিনি প্রতিপক্ষের অর্ধে ১৮৫টি পাস দিয়েছেন। ২৯টি ক্রসও দিয়েছেন তিনি, যা দলের মধ্যে সর্বোচ্চ। এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে তাদের শেষ ম্যাচে ৩-৪-২-১ ছকে খেলে মুম্বই। পেরেইরা দিয়াজকে সামনে রেখে তাঁর পিছন থেকে খেলেন এল খয়াতি ও স্টুয়ার্ট। রক্ষণে মেহতাব, গ্রিফিথ ও রাহুল ভেকে এবং মাঝমাঠে ছিলেন আকাশ মিশ্র, বিনীত রাই, রালতে ও বিক্রম প্রতাপ। এই ম্যাচে শুরু থেকে কারা খেলবেন, সেটাই দেখার।
ইস্টবেঙ্গল এফসি: গত মরশুমের সেরা গোলদাতা ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার ক্লেটন সিলভা ও মরশুমের প্রথম ডার্বির একমাত্র গোলদাতা নন্দকুমার শেখর নর্থইস্টের বিরুদ্ধে গোলে ফিরলেও গত ম্যাচে তাঁরা কিছু করতে পারেনননি। গোলের সুযোগ তৈরিতে নাওরেম মহেশ সিং বড় ভরসা। চলতি লিগে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (১৪) গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন তিনিই। সল ক্রেসপো, ক্লেটনরা দশটি করে সুযোগ তৈরি করেছেন। গোলে শটের সংখ্যার দিক থেকে ক্লেটন (৯) রয়েছেন সাত নম্বরে। স্প্যানিশ মিডফিল্ডার বোরহা হেরেরা গঞ্জালেস নর্থইস্টের বিরুদ্ধে মাঠে ফিরে আসেন এবং গোলও করেন। কিন্তু স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড হাভিয়ে সিভেরিও এখন পর্যন্ত কোনও গোল করতে পারেনি। আইএসএল কেরিয়ারে তাঁর সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে এখন। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সল ক্রেসপোও ছন্দে নেই। তবে স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হোসে পার্দো রক্ষণকে ভরসা জোগাচ্ছেন। সিনিয়র ডিফেন্ডার হরমনজ্যোৎ সিং খাবরার হাঁটুতে চোট। গত ম্যাচে তাঁর জায়গায় নিশু কুমার খেলেন। এই ম্যাচে মহম্মদ রকিপও এই জায়গায় শুরু করতে পারেন।
পরিসংখ্যান বলছে
গত দুই ম্যাচে কোনও গোল খায়নি মুম্বই সিটি এফসি। ইস্টবেঙ্গল এফসি-ও এই ব্যাপারে একই জায়গায় রয়েছে। এই প্রথম মুম্বই সিটি এফসি পরপর দুটি মরশুমে প্রথম সাত ম্যাচে কোনও হার মানেনি। এর আগে বেঙ্গালুরু এফসি-রও এই নজির ছিল ১৮-১৯ ও ১৯-২০ মরশুমে। এ মরশুমে ফাইনাল থার্ডে প্রতি ম্যাচে গড়ে ১৮.৩ টি করে পাস দিয়েছেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। এই ব্যাপারে তিনি রয়েছেন হুগো বুমৌসের (২৩.৫) পরেই। এ মরশুমে জর্জ পেরেইরা দিয়াজের কনভারশন রেট ৪২.৯%, যা চলতি লিগে সর্বোচ্চ। ১৪টি শটের মধ্যে ছ’টিতেই গোল পেয়েছেন তিনি।
ইস্টবেঙ্গল গত তিনটি ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে। ২০২০-র ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত তারা সাতটি ম্যাচে অপরাজিত ছিল। এ বার সেই রেকর্ড ভাঙতে পারবে কি তারা? সেবার তাদের অপরাজিত থাকার দৌড় থেমে যায় এই মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধেই, ০-১ হারে। এ বার ফের সেই দলেরই মুখোমুখি তারা। এ পর্যন্ত বক্সের বাইরে থেকে একটিও গোল খায়নি তারা। চলতি লিগে আর একটি দলের এই কৃতিত্ব রয়েছে, ওডিশা এফসি। নাওরেম মহেশ সিং আর একটি অ্যাসিস্ট করলে আইএসএল ইতিহাসে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ফুটবলার হবেন, যিনি দশটি অ্যাসিস্ট করবেন।
দ্বৈরথের ইতিহাস
আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল ও মুম্বই সিটি এফসি-র মধ্যে যে ছ’বার দেখা হয়েছে, তার মধ্যে চারবার জিতেছে সাগরপাড়ের দল। একটি জিতেছে ইস্টবেঙ্গল এফসি। বাকি একটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল দুই দলের পাঁচ বারের মুখোমুখিতে মাত্র ন’টি গোল হয়েছে এবং আটটিই দিয়েছে মুম্বই, একটি ইস্টবেঙ্গল। কলকাতার দল মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে একমাত্র জয়টি পায় গত মরশুমে। দুরন্ত গোল করেন মহেশ সিং। তার আগে প্রথম সাক্ষাতে ৩-০-য় জেতে মুম্বই। জোড়া গোল করেন আপুইয়া ও অপর গোল করেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। ২০২১-২২-এ প্রথম দেখায় গোলশূন্য থাকার পরে দ্বিতীয় লেগে বিপিন সিংয়ের ৫১ মিনিটের গোলে জেতে মুম্বই সিটি এফসি। তার আগের মরশুমে প্রথম ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০-য় এবং দ্বিতীয় বারে ১-০-য় হারায় মুম্বই। প্রথম ম্যাচে অ্যাডাম লে ফন্দ্রে জোড়া গোল করেন ও দ্বিতীয় মুখোমুখিতে মুর্তাদা ফলের গোলে জেতে সাগরপাড়ের দল।
ম্যাচ- মুম্বই সিটি এফসি বনাম ইস্টবেঙ্গল এফসি
ভেনু- মুম্বই ফুটবল এরিনা, মুম্বই
সময়- ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩, রাত ৮.০০
সরাসরি সম্প্রচার ও স্ট্রিমিং
টিভি চ্যানেল: ডিডি বাংলা ও কালার্স বাংলা সিনেমা- বাংলা, স্পোর্টস ১৮ খেল- হিন্দি, স্পোর্টস ১৮ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ, ভিএইচ ১ এসডি ও এইচডি- ইংলিশ
অ্যাপ: জিও সিনেমা ও ওয়ানফুটবল
খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com
অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার