Thursday, November 20, 2025
No menu items!
Google search engine
Homeফুটবলআনোয়ার আলি আর তাঁর লড়াইয়ের কাহিনী প্রেরণা দেবে পরবর্তী প্রজন্মকে

আনোয়ার আলি আর তাঁর লড়াইয়ের কাহিনী প্রেরণা দেবে পরবর্তী প্রজন্মকে

অলস্পোর্ট ডেস্ক: পাঞ্জাবের ছেলে হলে কী হবে, কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক রয়েছেন আনোয়ার আলি-র। এই যুবভারতীতেই রয়েছে তাঁর ফুটবল জীবনের একাধিক মধুর স্মৃতি। মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের তরুণ ডিফেন্ডার দেশের মাটিতে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে যে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন এই যুবভারতীতেই। সেই ম্যাচে কোনও গোল না খেয়েই মাঠ ছেড়েছিল ভারতীয় দল ও সেই দলের গর্বিত ডিফেন্ডাররা। এএফসি কাপ বাছাই পর্বে কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ২-০-য় জয় পেয়েছিল ভারত। 

পরের দু’টি ম্যাচেও খেলেন তিনি। আফগানিস্তান ও হংকংয়ের বিরুদ্ধে সেই দুই ম্যাচেও আসে জয়। হংকংয়ের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে গোল তো খানইনি আনোয়ার, বরং ভারতের হয়ে প্রথম গোলও করেন তিনি। দেশের হয়ে প্রথম ছয় ম্যাচেই একটি গোল, এই পরিসংখ্যান গর্ব করার মতোই।

এই শহর দিয়েছে অনেক মধুর স্মৃতি

যুবভারতী নিয়ে তাই তাঁর আবেগ একটু আলাদাই। বলছিলেন, “এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে এই মাঠেই দেশের হয়ে প্রথম গোল করি আমি। তাই এই মাঠে অনেক মধুর স্মৃতি আছে আমার”। এখন সেই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনই এখন আনোয়ারের ‘ঘরের মাঠ’। এ মরশুমের আগেই তিনি যোগ দেন দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে। ফলে ক্লাব বলুন বা দেশ, কলকাতার এই বিখ্যাত স্টেডিয়ামই এখন তাঁর ‘ফুটবল-হোম’।

কলকাতার এই মাঠ ও এই শহরের ফুটবলপ্রেমীদের ভালও বাসেন খুব। “এই স্টেডিয়ামে খেলতে নামলে বিশেষ ধরনের একটা অনুভূতি হয়। কলকাতার ফুটবলই তো অন্য রকমের। এখানকার মানুষ ফুটবলকে এত ভালবাসে! তাই এখানকার মাঠে খেলা মানে অন্য রকমের অনুভতি”, বলেন আনোয়ার। ইন্ডিয়ান সুপার লিগের ইউটিউব চ্যানেলে ‘ইন দ্য স্ট্যান্ডস’ অনুষ্ঠানে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলি বলেন তিনি। 

পাঞ্জাব থেকে উঠে আসা ২২ বছর বয়সী এই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার সম্প্রতি ভারতীয় দলের রক্ষণে বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন। সন্দেশ ঝিঙ্গনের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি ভারতীয় দলের রক্ষণে যথেষ্ট ভাল পারফরম্যান্সও দেখান। গত মরশুমে দিল্লি এফসি থেকে লোনে তিনি এফসি গোয়ার হয়ে খেলেন এবং আইএসএলেও নজর কাড়ার মতো পারফরম্যান্স দেখান। দেশের এক নম্বর লিগে এফসি গোয়ার জার্সি গায়ে কুড়িটি ম্যাচ ও সুপার কাপে দু’টি ম্যাচ খেলেন তিনি।

দেশের সেরা ফুটবল লিগে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে ভারতীয় দলের কোচ ইগর স্টিমাচ তাঁকে জাতীয় শিবিরে ডেকে নেন এবং নিয়মিত প্রথম এগারোয় খেলানও। গত বছর মে-তে আন্তর্জাতিক অভিষেক হওয়ার পরে ভারতীয় দলের হয়ে এ পর্যন্ত ১৬টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। মিনার্ভা পাঞ্জাব অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা আনোয়ার প্রথম স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও পরের উচ্চতার জন্য এবং দলের প্রয়োজনে কোচেদের পরামর্শে স্টপার হিসেবে খেলতে শুরু করেন। ফলে রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি তাঁর গোল করারও সহজাত দক্ষত রয়েছে। পাসও করেন যথেষ্ট ভাল। অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের সদস্য ছিলেন তিনি। জাতীয় অনূর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে আর্জেন্তিনার বিরুদ্ধে গোলও করেন তিনি।

স্বপ্নভঙ্গের সেই দুঃসময়

ইন্ডিয়ান অ্যারোজে খেলতে খেলতেই ২০১৭-১৮ মরশুমে তাঁর কাছে আইএসএল-এ খেলার সুযোগ আসে মুম্বই সিটি এফসি-র মাধ্যমে। কিন্তু মুম্বইয়ের ক্লাবে সই করার পরই এক অপ্রত্যাশিত কারণে তাঁর জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। তাঁর হৃদযন্ত্রের সমস্যার (হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি) জন্য মুম্বই সিটি এফসি-র পাশাপাশি সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনও তাঁর মাঠে নামার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

সেই কঠিন সময় সম্পর্কে এই একান্ত সাক্ষাৎকারে আনোয়ার বলেন, “যখন শারীরিক পরীক্ষার জন্য মুম্বইয়ে যাই, তখনই আমার হৃদযন্ত্রের সমস্যা ধরা পড়ে। প্রথম এক বা দু’সপ্তাহে ওরা আমাকে কিছুই বলেনি। একের পর এক টেস্ট করিয়ে গেলাম, যদি ভাল কিছু আসে, এই আশায়। কিন্তু বারবার একই ফল আসে। তখন ওরা আমাকে আমার হৃদযন্ত্রের অবস্থা জানায় এবং বলে দেয় যে, ওরা আমার নাম নথীভুক্ত করতে পারবে না”।

যে কোনও ফুটবলারের জীবনেই এই মুহূর্তের চেয়ে কঠিন মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না। তবু তিনি এ রকম দুঃসময়েও নিজেকে সামলেছিলেন। কী ভাবে? এই সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে আনোয়ার বলেন, “তখনই ধাক্কাটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে হঠাৎ মনে হল আমার কেরিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেল! তখন মাথায় নানা চিন্তা আসতে শুরু করল, ফুটবল না খেলতে পারলে করবটা কী? আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল সেটাই। খুব রাগ হয়েছিল তখন। অন্য কারও তো কোনও দোষ ছিল না। ওটা একটা শারীরিক সমস্যা, ঈশ্বরের ইচ্ছায় এমনটা হয়েছে। কারও সঙ্গে কথা বলতাম না। এমনকী ফোনেও কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগত না।

“নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিলাম। খাবারও খেতাম ঘরের মধ্যেই। কারণ, ঘরের বাইরে বেরোতেই ভাল লাগত না আমার। বেরোলে কেউ না কেউ আমাকে ঠিকই জিজ্ঞেস করত, কেন ট্রেনিং করছ না। সে জন্যই ওই ঘরটাই তখন আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। আমি নিজেই তখন এত হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম, পরিবারের সদস্যদেরও আর বিব্রত করতে চাইছিলাম না। তাই ছোটখাটো চোট বলে ওদের এড়িয়ে যেতাম, বলতাম তাড়াতাড়ি সেরে উঠব”।

ফিরে আসার কঠিন লড়াই

সেই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবের ফুটবল কর্তা মিনার্ভা অ্যাকাডেমির কর্ণধার রঞ্জিত বাজাজ। তিনিই আনোয়ারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ২২ মাস মাঠের বাইরে থাকার পরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে যুক্ত সঞ্জয় শর্মা নামক এক ব্যক্তির পরামর্শে তিনি মাঠে ফিরে আসার লড়াই শুরু করেন। সেই প্রসঙ্গে আনোয়ার বলেছেন, “তখন আমি রঞ্জিত (বাজাজ) স্যরের সঙ্গে কথা বলি। কারণ, ওঁর প্রতি আমার আস্থা ছিল। আমি তখন যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, তা ওঁর জন্যই। তখন উনি আমার পাশে দাঁড়ান ও আমাকে উজ্জীবিত করেন। আশ্বাস দেন, যাই হোক না কেন, চিন্তা কোরো না। খেলায় ফিরে এসো, আমি তোমাকে আমার টিমে খেলাব”।

এর পরে হাল ছাড়েননি আনোয়ার। হিমাচল, পাঞ্জাব, দিল্লিতে স্থানীয় লিগে খেলে নিজেকে তৈরি রেখেছিলেন। যদিও কখনও ভাবেননি, ফের আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবেন। সে কথা স্বীকার করে এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, আমি কখনও ভাবিনি, যে জায়গায় আমি পৌঁছতে পেরেছিলাম, সেই জায়গায় কোনও দিন ফিরে যেতে পারব। তার পরে মিস্টার সঞ্জয় শর্মার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় উনি ইংল্যান্ডে থাকেন ও প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আমার মতো ঘটনা অনেক সামলেছেন তিনি। আমি সব মেডিক্যাল রিপোর্ট তাঁকে পাঠাই এবং ওঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিই।

“আমার রিপোর্ট দেখে উনি বলেন, তুমি তো ভালই আছ, তোমার শারীরিক সমস্যা আছে ঠিকই। কিন্তু তা তোমার খেলা বন্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই তুমি খেলা চালিয়ে যেতে পারো। উনি আমাকে প্রতি বছর আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট পাঠাতে বলেন। বলেন, ‘আমি নিয়মিত সেগুলো পরীক্ষা করতে চাই’। সেগুলোর ভিত্তিতে উনি আমাকে বলে দিতেন, আমাকে কী করতে হবে, না হবে। এখন আমার সব মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রতি বছর ওঁকে পাঠাই। ওঁর সাহায্যেই আমি এখন খেলতে পারছি। তাঁর সাহায্যেই আবার পেশাদার ফুটবলে খেলার অনুমতি পাই আমি”

কথা রেখেছিলেন রঞ্জিত বাজাজ। ২০২১-এ তাঁরই ক্লাব দিল্লি এফসি-তে যোগ দেন আনোয়ার। সেবার দলকে ডুরান্ড কাপের নক আউট পর্বে উঠতে সাহায্য করেন তিনি। সে বছর আই লিগের বাছাই পর্বেও খেলেন দিল্লির ক্লাবের হয়ে এবং সাত ম্যাচে চার গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার শিরোপা অর্জন করেন। এই পারফরম্যান্সের ফলেই ২০২১-২২ মরশুমের মাঝখানে এফসি গোয়া থেকে তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে এবং ১৮ মাসের লোনের চুক্তিতে তিনি গোয়ার দলে যোগ দেন।

যুদ্ধ জয়ের পর ফের স্বপ্নের দৌড় শুরু

গোয়ার হয়ে অভিষেক ম্যাচেই ক্লিন শিট রাখেন তিনি ও চেন্নাইন এফসি-কে ১-০-য় হারাতে সাহায্য করেন। সে মরশুমে গোয়ার দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন তিনি এবং টানা দশটি ম্যাচে খেলেন আনোয়ার। একসময় যিনি ভেবেই নিয়েছিলেন, আর তাঁর আইএসএলে ফিরে আসা সম্ভব হবে না, সেই আনোয়ার এফসি গোয়ার প্রস্তাব পেয়ে কী ভেবেছিলেন, তা বলেছেন এই সাক্ষাৎকারে। বলেন, “এফসি গোয়ার প্রস্তাবটা পেয়ে তো আমি চমকে যাই। কারণ, সেই মুহূর্তটার অপেক্ষায় সারা জীবন ছিলাম আমি। তখন একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কিছুটা নার্ভাসও ছিলাম। কারণ, অনেক দিন পরে সর্বোচ্চ স্তরে খেলার জন্য আত্মবিশ্বাসটাও দরকার ছিল আমার। তখন এই ব্যাপারটাও আমার মনের মধ্যে চলছিল যে, আমার শরীরে একটা সমস্যা রয়েছে। আইএসএলের সেই একটা বছর খুব কঠিন কেটেছিল। কিন্তু মাঠে আমি আমার একশো শতাংশ দিয়েছিলাম। কারণ, মাঠের বাইরের সমস্যা মাঠের মধ্যে নিয়ে আসতে চাইনি আমি”।

পরের মরশুমে, অর্থাৎ ২০২২-২৩ মরশুমে আনোয়ার এফসি গোয়ার হয়ে ২০টি ম্যাচেই খেলেন। জীবনের প্রথম আইএসএল গোলটিও সে বারই করেন তিনি। দু’টি গোলে অ্যাসিস্টও করেন। সবচেয়ে বেশি নিখুঁত পাস দেওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনিই ছিলেন এক নম্বরে। তাঁর পাসিং অ্যাকিউরেসি ছিল ৮২.৭৫ শতাংশ।

তাঁর এই পারফরম্যান্সের জন্য গতবারের আইএএসএল নক আউট চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের কোচ হুয়ান ফেরান্দোর নজরে পড়ে যান তিনি। ডুরান্ড কাপ ও এএফসি কাপের প্রাথমিক পর্ব মিলিয়ে সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে সাতটি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের হয়ে তিনটি গোলও করে ফেলেছেন। অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যয়ের এই ‘সুপারমডেল’-এর আরও কত লক্ষ্য ও স্বপ্ন পূরণ হবে, তা তো সময়ই জানে। তবে কলকাতায় খেলতে এসে যে তিনি স্বপ্নের দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছেন, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

মোহনবাগান সুপার জায়ান্টে খেলা নিয়ে আনোয়ারের বক্তব্য, “এই ক্লাবের হয়ে খেলতে গেলে প্রচুর আত্মবিশ্বাস লাগে। কারণ, এখানে একেবারে অন্য রকমের চাপ থাকে। এ রকম বড় ক্লাবে সমর্থকদের চাপ সবসময়ই থাকে। আমাদের দারুণ দারুণ খেলোয়াড় আছে, তাই আমাদের কাছে প্রত্যাশাও বেশি। তো আমারও এই ক্লাবের হয়ে খেলার খুব ইচ্ছে ছিল। এ রকম একটা দলের হয়ে  খেলার বাসনা সবারই থাকে। আমার কাছেও এটা ছিল স্বপ্ন, যা সত্যি হয়েছে। আরও বড় স্বপ্ন ছিল এই ক্লাবের হয়ে গোল করা! এটাও আমার কাছে কম বড় কাজ নয়। এ এমন এক অভিজ্ঞতা, যা আমার মনের মণিকোঠায় আলাদা জায়াগায় থাকবে”।    

(লেখা আইএসএল ওয়েবসাইট থেকে)

খেলার খবরের জন্য ক্লিক করুন: www.allsportindia.com

অলস্পোর্ট নিউজের সঙ্গে থাকতে লাইক আর ফলো করুন: ফেসবুক ও টুইটার

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments